ইন্দ্র পতন

তখনও অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু
অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরুগুরুগুরু গুরু।
আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন্ ইন্দ্রের আগমনি?
শুনি, অম্বুদ-কম্বু-নিনাদে ঘন বৃংহিত-ধ্বনি।
বাজে চিক্কুর-হ্রেষা-হর্ষণ মেঘ-মন্দুরা-মাঝে,
সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলংকর সাজে!

ঘনায় অশ্রু-বাষ্প-কুহেলি ঈশান-দিগঙ্গনে,
স্তব্ধ-বেদনা দিগ্‌বালিকারা কী যেন কাঁদনি শোনে!
কাঁদিছে ধরার তরুলতাপাতা, কাঁদিতেছে পশুপাখি,
ধরার ইন্দ্র স্বর্গে চলেছে ধূলির মহিমা মাখি।
বাজে আনন্দ-মৃদঙ গগনে, তড়িৎ-কুমারী নাচে,
মর্ত্য-ইন্দ্র বসিবে গো আজ স্বর্গ-ইন্দ্র কাছে!
সপ্ত-আকাশ-সপ্তস্বরা হানে ঘন করতালি,
কাঁদিছে ধরায় তাহারই প্রতিধ্বনি – খালি, সব খালি!

হায় অসহায় সর্বংসহা মৌনা ধরণি মাতা,
শুধু দেব-পূজা তরে কি মা তোর পুষ্প হরিৎ-পাতা?
তোর বুকে কি মা চির-অতৃপ্ত রবে সন্তান-ক্ষুধা?
তোমার মাটির পাত্রে কি গো মা ধরে না অমৃত-সুধা?
জীবন-সিন্ধু মথিয়া যে-কেহ আনিবে অমৃত-বারি,
অমৃত-অধিপ দেবতার রোষ পড়িবে কি শিরে তারই?
হয়তো তাহাই, হয়তো নহে তা, – এটুকু জেনেছি খাঁটি,
তারে স্বর্গের আছে প্রয়োজন, যারে ভালোবাসে মাটি।

কাঁটার মৃণালে উঠেছিল ফুটে যে চিত্ত-শতদল,
শোভেছিল যাহে বাণী কমলার রক্ত-চরণ-তল,
সম্ভ্রমে-নত পূজারি মৃত্যু ছিঁড়িল সে-শতদলে –
শ্রেষ্ঠ অর্ঘ অর্পিবে বলি নারায়ণ-পদতলে!
জানি জানি মোরা, শঙ্খ-চক্র-গদা যাঁর হাতে শোভে –
পায়ের পদ্ম হাতে উঠে তাঁর অমর হইয়া রবে।
কত সান্ত্বনা-আশা-মরীচিকা, কত বিশ্বাস-দিশা
শোক-সাহারায় দেখা দেয় আসি, মেটে না প্রাণের তৃষা!
দুলিছে বাসুকি মণিহারা ফণী, দুলে সাথে বসুমতী,
তাহার ফণার দিনমণি আজ কোন্ গ্রহে দেবে জ্যোতি!

জাগিয়া প্রভাতে হেরিনু আজিকে জগতে সুপ্রভাত,
শয়তানও আজ দেবতার নামে করিছে নান্দীপাঠ!
হে মহাপুরুষ, মহাবিদ্রোহী, হে ঋষি, সোহম্-স্বামী!
তব ইঙ্গিতে দেখেছি সহসা সৃষ্টি গিয়াছে থামি,
থমকি গিয়াছে গতির বিশ্ব চন্দ্র-সূর্য-তারা,
নিয়ম ভুলেছে কঠোর নিয়তি, দৈব দিয়াছে সাড়া!

যখনই স্রষ্টা করিয়াছে ভুল, করেছ সংস্কার,
তোমারই অগ্রে স্রষ্টা তোমারে করেছে নমস্কার।
ভৃগুর মতন যখনই দেখেছ অচেতন নারায়ণ,
পদাঘাতে তাঁর এনেছ চেতনা, কেঁপেছে জগজ্জন!
ভারত-ভাগ্য-বিধাতা বক্ষে তব পদ-চিন ধরি
হাঁকিছেন, ‘আমি এমনি করিয়া সত্য স্বীকার করি।
জাগাতে সত্য এত ব্যাকুলতা এত অধিকার যার,
তাহার চেতন-সত্যে আমার নিযুত নমস্কার।’

আজ শুধু জাগে তব অপরূপ সৃষ্টি-কাহিনি মনে,
তুমি দেখা দিলে অমিয়-কণ্ঠ বাণীর কমল-বনে!
কখন তোমার বীণা ছেয়ে গেল সোনার পদ্ম-দলে,
হেরিনু সহসা ত্যাগের তপন তোমার ললাট-তলে!
লক্ষ্মী দানিল সোনার পাপড়ি, বীণা দিল করে বাণী,
শিব মাখালেন ত্যাগের বিভূতি কণ্ঠে গরল দানি।
বিষ্ণু দিলেন ভাঙনের গদা, যশোদা-দুলাল বাঁশি,
দিলেন অমিত তেজ ভাস্কর, মৃগাঙ্ক দিল হাসি।
চীর গৈরিক দিয়া আশিসিল ভারত-জননী কাঁদি,
প্রতাপ-শিবাজী দানিল মন্ত্র, দিল উষ্ণীষ বাঁধি।
বুদ্ধ দিলেন ভিক্ষাভাণ্ড, নিমাই দিলেন ঝুলি,
দেবতারা দিল মন্দার-মালা, মানব মাখাল ধূলি।
নিখিল-চিত্ত-রঞ্জন তুমি উদিলে নিখিল ছানি –
মহাবীর, কবি, বিদ্রোহী, ত্যাগী, প্রেমিক, কর্মী, জ্ঞানী!
হিমালয় হতে বিপুল বিরাট, উদার আকাশ হতে,
বাধা-কুঞ্জর তৃণসম ভেসে গেল তব প্রাণ-স্রোতে

ছন্দ-গানের অতীত হে ঋষি, জীবনে পারিনি তাই
বন্দিতে তোমা, আজ আনিয়াছি চিত্ত-চিতার ছাই!
বিভূতি-তিলক! কৈলাস হতে ফিরেছ গরল পিয়া,
এনেছি অর্ঘ্য শ্মশানের কবি ভস্ম-বিভূতি নিয়া!
নাও অঞ্জলি, অঞ্জলি নাও, আজ আনিয়াছি গীতি,
সারা জীবনের না-কওয়া-কথার ক্রন্দন-নীরে তিতি!
এত ভালো মোরে বেসেছিলে তুমি, দাওনিকো অবসর
আমারেও ভালোবাসিবার, আজ তাই কাঁদে অন্তর!

আজিকে নিখিল-বেদনার কাছে মোর ব্যথা কতটুক্,
ভাবিয়া ভাবিয়া সান্ত্বনা খুঁজি, তবু হা হা করে বুক!
আজ ভারতের ইন্দ্র-পতন, বিশ্বের দুর্দিন,
পাষাণ বাংলা পড়ে এককোণে স্তব্ধ অশ্রুহীন।
তারই মাঝে হিয়া থাকিয়া থাকিয়া গুমরি গুমরি ওঠে,
বক্ষের বাণী চক্ষের জলে ধুয়ে যায়, নাহি ফোটে!
দীনের বন্ধু, দেশের বন্ধু, মানব-বন্ধু তুমি,
চেয়ে দেখো আজ লুটায় বিশ্ব তোমার চরণ চুমি।
গগনে তেমনই ঘনায়েছে মেঘ, তেমনই ঝরিছে বারি,
বাদলে ভিজিয়া শত স্মৃতি তব হয়ে আসে ঘন ভারী।
পয়গম্বর ও অবতার-যুগে জন্মিনি মোরা কেহ,
দেখিনিকো মোরা তাঁদেরে, দেখিনি দেবের জ্যোতির্দেহ।
কিন্তু যখনই বসিতে পেয়েছি তোমার চরণ-তলে,
না জানিতে কিছু না বুঝিতে কিছু নয়ন ভরেছে জলে।
সারা প্রাণ যেন অঞ্জলি হয়ে ও-পায়ে পড়েছে লুটি,
সকল গর্ব উঠেছে মধুর প্রণাম হইয়া ফুটি।
বুদ্ধের ত্যাগ শুনেছি মহান, দেখিনিকো চোখে তাহে,
নাহি আপশোশ, দেখেছি আমরা ত্যাগের শাহানশাহে,
নিমাই লইল সন্ন্যাস প্রেমে, দিইনিকো তাঁরে ভেট,
দেখিয়াছি মোরা ‘রাজা-সন্ন্যাসী’ প্রেমের জগত-শেঠ।

শুনি, পরার্থে প্রাণ দিয়া দিল অস্থি বনের ঋষি;
হিমালয় জানে, দেখেছি দধীচি গৃহে বসে দিবানিশি!
হে নবযুগের হরিশচন্দ্র! সাড়া দাও, সাড়া দাও!
কাঁদিছে শ্মশানে সুত-কোলে সতী, রাজর্ষি ফিরে চাও!
রাজকুলমান পুত্র-পত্নী সকল বিসর্জিয়া,
চণ্ডাল বেশে ভারত-শ্মশান ছিলে একা আগুলিয়া,
এসো সন্ন্যাসী, এসো সম্রাট, আজি সে শ্মশান-মাঝে,
ওই শোনো তব পুণ্যে জীবন-শিশুর কাঁদন বাজে!

দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যূপে ফেলে
ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ বীর বারেবারে অবহেলে।
ইব্রাহিমের মতো বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া
কোরবানি দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবি-হিয়া।
ফেরেশতা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা,
ভগবান-বুকে মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা!

প্রজা-রঞ্জন রাম-রাজা দিল সীতারে বিসর্জন,
তাঁরও হয়েছিল যজ্ঞে স্বর্ণ-জানকীর প্রয়োজন;
তব ভাণ্ডার-লক্ষ্মীরে রাজা নিজ-হাতে দিল তুলি
ক্ষুধা-তৃষাতুর মানবের মুখে, নিজে নিলে পথ-ধূলি।
হেম-লক্ষ্মীর তোমারও জীবনযাগে ছিল প্রয়োজন,
পুড়িলে যজ্ঞে, তবু নিলে নাকো দিলে যা বিসর্জন!
তপোবলে তুমি অর্জিলে তেজ বিশ্বামিত্র-সম,
সারা বিশ্বের ব্রাহ্মণ তাই বন্দিছে নমো নমো!

হে যুগ-ভীষ্ম। নিন্দার শরশয্যায় তুমি শুয়ে
বিশ্বের তরে অমৃতমন্ত্র বীর-বাণী গেলে থুয়ে।
তোমার জীবনে বলে গেলে – ওগো কল্কি আসার আগে
অকল্যাণের কুরুক্ষেত্রে আজও মাঝে মাঝে জাগে
চিরসত্যের পাঞ্জজন্য, কৃষ্ণের মহাগীতা,
যুগে যুগে কুরু-মেদ-ধূমে জ্বলে অত্যাচারের চিতা।
তুমি নবব্যাস, গেলে নবযুগ-জীবন-ভারত রচি,
তুমিই দেখালে – ইন্দ্রেরই তরে পারিজাত-মালা, শচী!

আসিলে সহসা অত্যাচারীর প্রাসাদ-স্তম্ভ টুটি
নব-নৃসিংহ-অবতার তুমি, পড়িল বক্ষে লুটি
আর্ত-মানব-হৃদি-প্রহ্লাদ, পাগল মুক্তি-প্রেমে!
তুমি এসেছিলে জীবন-গঙ্গা তৃষাতুর তরে নেমে।
দেবতারা তাই স্তম্ভিত হেরো দাঁড়ায়ে গগন-তলে,
নিমাই তোমারে ধরিয়াছে বুকে, বুদ্ধ নিয়াছে কোলে।

তোমারে দেখিয়া কাহারও হৃদয়ে জাগেনিকো সন্দেহ
হিন্দু কিংবা মুসলিম তুমি অথবা অন্য কেহ।
তুমি আর্তের, তুমি বেদনার, ছিলে সকলের তুমি,
সবারে যেমন আলো দেয় রবি, ফুল দেয় সবে ভূমি।
হিন্দুর ছিলে আকবর, মুসলিমের আরংজিব,
যেখানে দেখেছ জীবের বেদনা, সেখানে দেখেছ শিব!

নিন্দা-গ্লানির পঙ্ক মাখিয়া, পাগল, মিলন-হেতু
হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে সেতু!
জানি না আজিকে কী অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান,
ঈর্ষাপঙ্কে পঙ্কজ হয়ে ফুটুক এদের প্রাণ।

হে অরিন্দম, মৃত্যুর তীরে করেছ শত্রু জয়,
প্রেমিক! তোমার মৃত্যু-শ্মশান আজিকে মিত্রময়!
তাই দেখি, যারা জীবনে তোমায় দিল কণ্টক-হুল,
আজ তাহারাই এনেছে অর্ঘ্য নয়ন-পাতার ফুল!
কে যে ছিলে তুমি, জানি নাকো কেহ, দেবতা কি আওলিয়া,
শুধু এই জানি, হেরে আর কারে ভরেনি এমন হিয়া।

আজ দিকে দিকে বিপ্লব-অহিদল খুঁজে ফেরে ডেরা,
তুমি ছিলে এই নাগ-শিশুদের ফণি-মনসার বেড়া।
তুমিই রাজার ঐরাবতের পদতল হতে তুলে
বিষ্ণু-শ্রীকর-অরবিন্দরে আবার শ্রীকরে থুলে!
তুমি দেখেছিলে ফাঁসির গোপীতে বাঁশির গোপীমোহন
তোমার ভগ্ন চাকায় জড়ায়ে চালায়েছে এরা রথ,
আপন মাথার মানিক জ্বালায়ে দেখায়েছে রাতে পথ।
আজ পথ-হারা আশ্রয়হীন তাহারা যে মরে ঘুরে,
গুহা-মুখে বসি ডাকিছে সাপুড়ে মারণমন্ত্র সুরে!

যেদিকে তাকাই কূল নাহি পাই, অকূল হতাশ্বাস,
কোন শাপে ধরা স্বরাজরথের চক্র করিল গ্রাস?
যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে রণে পড়িল সব্যসাচী,
ওই হেরো, দূরে কৌরবসেনা উল্লাসে ওঠে নাচি।
হিমালয় চিরে আগ্নেয়-যান চিৎকার করি ছুটে,
শত ক্রন্দন-গঙ্গা যেন গো পড়িছে পিছনে টুটে!
স্তব্ধ-বেদনা গিরিরাজ ভয়ে জলদে লুকায় কায় –
নিখিল অশ্রু-সাগর বুঝিবা তাহারে ডুবাতে চায়!
টুটিয়াছে আজ গর্ব তাহার, লাজে নত উঁচু শির,
ছাপি হিমাদ্রি উঠিছে প্রণাম সমগ্র পৃথিবীর!
ধূর্জটি-জটাবাহিনী গঙ্গা কাঁদিয়া কাঁদিয়া চলে,
তারই নীচে চিতা – যেন গো শিবের ললাটে অগ্নি জ্বলে!

মৃত্যু আজিকে হইল অমর পরশি তোমার প্রাণ,
কালো মুখ তার হল আলোময়, শ্মশানে উঠিছে গান!
অগুরু-পুষ্প-চন্দন পুড়ে হল সুগন্ধতর,
হল শুচিতর অগ্নি আজিকে, শব হল সুন্দর।
ধন্য হইল ভাগীরথীধারা তব চিতা-ছাই মাখি,
সমিধ হইল পবিত্র আজি কোলে তব দেহ রাখি।

অসুরনাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্‌বোধনে
আঁখি উপাড়িতে গেছিলেন রাম, আজিকে পড়িছে মনে,
রাজর্ষি! আজি জীবন উপাড়ি দিলে অঞ্জলি তুমি,
দনুজদলনী জাগে কিনা – আছে চাহিয়া ভারতভূমি।

হুগলি
১১ই আষাঢ় ১৩৩২

রাজ ভিখারি

কোন্ ঘর-ছাড়া বিবাগির বাঁশি শুনে উঠেছিলে জাগি
ওগো চির-বৈরাগী!
দাঁড়ালে ধূলায় তব কাঞ্চন-কমল-কানন ত্যাগি –
ওগো চির-বৈরাগী!

ছিলে ঘুম-ঘোরে রাজার দুলাল,
জানিতে না কে সে পথের কাঙাল
ফেরে পথে পথে ক্ষুধাতুর-সাথে ক্ষুধার অন্ন মাগি,
তুমি সুধার দেবতা ‘ক্ষুধা’ ‘ক্ষুধা’ বলে কাঁদিয়া উঠিলে জাগি –
ওগো চির-বৈরাগী।

আঙিয়া তোমার নিলে বেদনার গৈরিক-রঙে রেঙে,
মোহ-ঘুমপুরী উঠিল শিহরি চমকিয়া ঘুম ভেঙে,
জাগিয়া প্রভাতে হেরে পুরবাসী
রাজা দ্বারে দ্বারে ফেরে উপবাসী,
সোনার অঙ্গ পথের ধূলায় বেদনার দাগে দাগী!
কে গো নারায়ণ, নররূপে এলে নিখিল-বেদনা-ভাগী –
ওগো চির-বৈরাগী!

‘দেহি ভবতি ভিক্‌ষাম’ বলি দাঁড়ালে রাজ-ভিখারি,
খুলিল না দ্বার, পেলে না ভিক্ষা, দ্বারে দ্বারে ভয় দ্বারী।
বলিলে, ‘দেবে না? লহো তবে দান
ভিক্ষাপূর্ণ আমার এ প্রাণ!’ –
দিল না ভিক্ষা, নিল নাকো দান, ফিরিয়া চলিলে যোগী!
যে-জীবন কেহ লইল না তাহা মৃত্যু লইল মাগি॥
হুগলি
১৭ই আষাঢ় ১৩৩২

সান্ত্বনা

চিত্ত-কুঁড়ি-হাসনাহেনা মৃত্যু-সাঁঝে ফুটল গো!
জীবন-বেড়ার আড়াল ছাপি বুকের সুবাস টুটল গো!
এই তো কারার প্রাকার টুটে
বন্দি এল বাইরে ছুটে,
তাই তো নিখিল আকুল-হৃদয় শ্মশান-মাঝে জুটল গো!
ভবন-ভাঙা আলোর শিখায় ভুবন রেঙে উঠল গো।

স্ব-রাজ দলের চিত্তকমল লুটল বিশ্বরাজের পায়,
দলের চিত্ত উঠল ফুটে শতদলের শ্বেত আভায়।
রূপের কুমার আজকে দোলে
অপরূপের শিশ-মহলে,
মৃত্যু-বাসুদেবের কোলে কারার কেশব ওই গো যায়,
অনাগত বৃন্দাবনে মা যশোদা শাঁখ বাজায়!

আজকে রাতে যে ঘুমুল, কালকে প্রাতে জাগবে সে।
এই বিদায়ের অস্ত-আঁধার উদয়-উষায় রাঙবে রে!
শোকের নিশির শিশির ঝরে,
ফলবে ফসল ঘরে-ঘরে,
আবার শীতের রিক্ত শাখায় লাগবে ফুলেল রাগ এসে।
যে মা সাঁঝে ঘুম পাড়াল, চুম দিয়ে ঘুম ভাঙবে সে।

না ঝরলে তাঁর প্রাণ-সাগরে মৃত্যু-রাতের হিম-কণা
জীবন-শুক্তি ব্যর্থ হত, মুক্তি-মুক্তা ফলত না।
নিখিল-আঁখির ঝিনুক-মাঝে
অশ্রু-মানিক ঝলত না যে!
রোদের উনুন না নিবিলে চাঁদের সুধা গলত না।
গগন-লোকে আকাশ-বধূর সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বলত না।

মরা বাঁশে বাজবে বাঁশি, কাটুক না আজ কুঠার তায়,
এই বেণুতেই ব্রজের বাঁশি হয়তো বাজবে এই হেথায়।
হয়তো এবার মিলন-রাসে
বংশীধারী আসবে পাশে
চিত্ত-চিতার ছাই মেখে শিব সৃষ্টি-বিষাণ ওই বাজায়।
জন্ম নেবে মেহেদি-ঈশা ধরার বিপুল এই ব্যথায়।

কর্মে যদি বিরাম না রয়, শান্তি তবে আসত না!
ফলবে ফসল – নইলে নিখিল নয়ন-নীরে ভাসত না।
নেইকো দেহের খোসার মায়া,
বীজ আনে তাই তরুর ছায়া,
আবার যদি না জন্মাত, মৃত্যুতে সে হাসত না।
আসবে আবার – নইলে ধরায় এমন ভালো বাসত না!

অভেদম্

দেখিয়াছ সেই রূপের কুমারে, গড়িছে যে এই রূপ?
রূপে রূপে হয় রূপায়িত যিনি নিশ্চল নিশ্চুপ!
কেবলই রূপের আবরণে যিনি ঢাকিছেন নিজ কায়া
লুকাতে আপন মাধুরী যে জন কেবলই রচিছে মায়া!
সেই বহুরূপী পরম একাকী এই সৃষ্টির মাঝে
নিষ্কাম হয়ে কীরূপে সতত রত অনন্ত কাজে।
পরম নিত্য হয়ে অনিত্য রূপ নিয়ে এই খেলা
বালুকার ঘর গড়িছে ভাঙিছে সকাল-সন্ধ্যা বেলা।
আমরা সকলে খেলি তারই সাথে, তারই সাথে হাসি কাঁদি
তারই ইঙ্গিতে ‘পরম-আমি’রে শত বন্ধনে বাঁধি।
মোরে ‘আমি’ ভেবে তারে স্বামী বলি দিবাযামী নামি উঠি,
কভু দেখি – আমি তুমি যে অভেদ, কভু প্রভু বলে ছুটি।

একাকী হইয়া একা-একা খেলি, চুপ করে বসে থাকি।
ভালো নাহি লাগে, কেন সাধ জাগে খেলুড়িরে কাছে ডাকি!
সৃষ্টির ঘুড়ি উড়াই শূন্যে, আনন্দে প্রাণ নাচে,
দেখি সে লাটাই লুটায়ে পড়েছে কখন পায়ের কাছে।
বীজ রূপে রই – নিজ রূপ কই? খুঁজিতে সহসা দেখি
সেই বীজ-আমি মহাতরু হয়ে ছড়ায়ে পড়েছি – এ কী!
শাখাপ্রশাখায় পল্লবে-ফুলে ফলে-মূলে কত রূপে
কখন আমারে বিকশিত করি খেলিতেছি চুপে চুপে!
কত সে বিহগ-বিহগী আসিয়া বেঁধেছে আমাতে নীড়,
ঊর্ধ্বে নিম্নে কত অনন্ত আলো আঁধারের ভিড়।
অনন্ত দিকে অনন্ত শাখা, অনন্ত রূপ ধরি
উদ্ভিদ জড় জীব হয়ে আমি ফিরিতেছি সঞ্চরি।

চির-আনমনা উদাসীন, তাই নিজ সৃষ্টিরই মাঝে
হেরি কত শত ছন্দপতন অপূর্ণতা বিরাজে।
চমকি উঠিয়া সংহার করি আপনার সেই ভুল,
সেই ভুল দিয়া নতুন করিয়া ফুটাই সৃষ্টি-ফুল।
মৃত্যু কেমন লাগে মোর কাছে, শোনো সে বাণী অভয়,
আঁখির পলক পড়িলে যেমন ক্ষণিক সৃষ্টি-লয়,
একটি পলক আঁধারে হেরিয়া আবার সৃষ্টি হেরি,
মৃত্যুর পরে জীবন আসিতে ততটুকু হয় দেরি!
মৃত্যুর ভয় ভীত যারা, হয় তাদেরই নরকভোগ,
অমৃতে সেই ডুবে আছে, যার নিত্য আত্ম-যোগ!
মোরই আনন্দ সৃষ্টি করিছে স্ত্রী ও পুত্র আদি,
কেবলই মিলন লাগে নাকো ভালো, বিরহ রচিয়া কাঁদি।

কেবল শান্তি শ্রান্তি আনিলে নিজে অশান্তি আনি,
ভুলিয়া স্বরূপ ঠুলি পরে টানি শত কর্মের ঘানি।
রুদ্রের রূপে সংহার করি, প্রেমময় রূপে কাঁদি,
যারে ‘তুমি’ বল, সেই ‘আমি’ খুঁজি নিজের অন্ত আদি।
সংসারে আসি সং সেজে আমি – শত প্রিয়জন লয়ে,
আপনারে ভোগ করিতে জন্মি বিপুল তৃষ্ণা হয়ে।
যত ভোগ করি তত আপনার তৃষ্ণা বাড়িয়া যায়
অমৃত-মধু মদ হয়ে উঠে তৃষ্ণায় পিয়ালায়!
বন্ধু! কেমনে মিটিবে তৃষ্ণা পূর্ণেরে নাহি পেলে,
আমি যে নিজেই অপূর্ণরূপে এসেছি পূর্ণে ফেলে!
সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার – এই তিন রূপই যাঁর লীলা,
সেই সাগরের আমি যে ঊর্মি, বিরহিণী ঊর্মিলা!

দুখ শোক ব্যাধি নিজে লই সাধি, – কখনও অত্যাচারী-
অসুর সাজিয়া কেড়ে খাই – পুন দেবতা সাজিয়া মারি!
বিদ্বেষ নাই, আসক্তিহীন শুধু সে খেলার ঝোঁকে
অসাম্য করি সৃজন – আবার সংহার করি ওকে।
খেলিতে খেলিতে সহসা চকিতে দেখি আপনারই কায়া
শ্রী ও সামঞ্জস্যবিহীন এ কী কুৎসিত ছায়া!
সেই কুৎসিত শ্রীহীন অসুরে তখনই বধিতে চাই,
মোর বিদ্রোহ সাম্য-সৃষ্টি – নাই সেথা ভেদ নাই।
নাই সেথা যশ তৃষ্ণার লোভ, নাই বিরোধের ক্লেদ,
নাই সেথা মোর হিংসার ভয়, নাই সেথা কোনো ভেদ,
নাই অহিংসা-হিংসা, সেখানে কেবল পরম সাম,
রাজনীতি নাই, কোনো ভীতি নাই, ‘অভেদম্’ তার নাম।

অভয় সুন্দর

কুৎসিত যাহা, অসাম্য যাহা সুন্দর ধরণিতে –
হে পরম সুন্দরের পূজারি! হবে তাহা বিনাশিতে।
তব প্রোজ্জ্বল প্রাণের বহ্নিশিখায় দহিতে তারে
যৌবন ঐশ্বর্য-শক্তি লয়ে আসে বারে বারে।
যৌবনের এ ধর্ম বন্ধু, সংহার করি জরা
অজর অমর করিয়া রাখে এ প্রাচীনা বসুন্ধরা।
যৌবনের সে ধর্ম হারায়ে বিধর্মী তরুণেরা –
হেরিতেছি আজ ভারতে – রয়েছে জরার শকুনে ঘেরা।

যুগে যুগে জরাগ্রস্ত যযাতি তারই পুত্রের কাছে
আপন বিলাস ভোগের লাগিয়া যৌবন তার যাচে।
যৌবনে করি বাহন তাহার জরা চলে রাজপথে
হাসিছে বৃদ্ধ যুবক সাজিয়া যৌব-শক্তি-রথে।
জ্ঞান-বৃদ্ধের দন্তবিহীন বৈদান্তিক হাসি
দেখিছ তোমরা পরমানন্দে – আমি আঁখিজলে ভাসি
মহাশক্তির প্রসাদ পাইয়া চিনিলে না হায় তারে
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া ফিরিতেছ দ্বারে দ্বারে।

এই কি তরুণ? অরুণে ঢাকিবে বৃদ্ধের ছেঁড়া কাঁথা
এই তরুণের বুকে কি পরম-শক্তি-আসন পাতা?
ধূর্ত বুদ্ধিজীবীর কাছে কি শক্তি মানিবে হার?
ক্ষুদ্র রুধিবে ভোলানাথ শিব মহারুদ্রের দ্বার?
ঐরাবতেরে চালায় মাহুত শুধু বুদ্ধির ছলে –
হে তরুণ, তুমি জান কি হস্তী-মূর্খ কাহারে বলে?
অপরিমাণ শক্তি লইয়া ভাবিছ শক্তিহীন –
জরারে সেবিয়া লভিতেছ জরা, হইতেছ আয়ুক্ষীণ।

পেয়ে ভগবদ্-শক্তি যাহারা চিনিতে পারে না তারে
তাহাদের গতি চিরদিন ওই তমসার কারাগারে।
কোন লোভে, কোন মোহে তোমাদের এই নিম্নগ গতি?
চাকুরির মায়া হরিল কি তব এই ভগবদ্-জ্যোতি?
সংসারে আজও প্রবেশ করনি, তবু সংসার – মায়া
গ্রাস করিয়াছে তোমার শক্তি তোমার বিপুল কায়া।
শক্তি ভিক্ষা করিবে যাহারা ভোট-ভিক্ষুক তারা!
চেন কি – সূর্য-জ্যোতিরে লইয়া উনুন করেছে যারা?

চাকুরি করিয়া পিতামাতাদের সুখী করিতে কি চাহ?
তাই হইয়াছে নুড়ো-মুখ যত বুড়োর তলপিবাহ?
চাকর হইয়া বংশের তুমি করিবে মুখোজ্জ্বল?
অন্তরে পেয়ে অমৃত, অন্ধ, মাগিতেছ হলাহল!
হউক সে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট কি মন্ত্রী কমিশনার –
স্বর্ণের গলাবন্ধ পরুক – সারমেয় নাম তার!
দাস হইবার সাধনা যাহার নহে সে তরুণ নহে –
যৌবন শুধু খোলস তাহার – ভিতরে জরারে বহে।

নাকের বদলে নরুন-চাওয়া এ তরুণেরে নাহি চাই –
আজাদ-মুক্ত-স্বাধীনচিত্ত যুবাদের গান গাই।
হোক সে পথের ভিখারি, সুবিধা-শিকারি নহে যে যুবা
তারই জয়গাথা গেয়ে যায় চিরদিন মোর দিলরুবা।
তাহারই চরণধূলিরে পরম প্রসাদ বলিয়া মানি
শক্তিসাধক তাহারেই আমি বন্দি যুক্ত-পাণি।
মহা-ভিক্ষু তাহাদেরই লাগি তপস্যা করি আজও
তাহাদেরই লাগি হাঁকি নিশিদিন – ‘বাজো রে শিঙ্গা বাজো!’

সমাধির গিরিগহ্বরে বসি তাহাদেরই পথ চাহি –
তাহাদেরই আভাস পেলে মনে হয় পাইলাম বাদশাহি!
মোর সমাধির পাশে এলে কেউ, ঢেউ ওঠে মোর বুকে –
‘মোর চির-চাওয়া বন্ধু এলে কি’ বলে চাহি তার মুখে।
জ্যোতি আছে হায় গতি নাই হেরি তার মুখ পানে চেয়ে –
কবরে ‘সবর’ করিয়া আমার দিন যায় গান গেয়ে!
কারে চাই আমি কী যে চাই হায় বুঝে না উহারা কেহ।
দেহ দিতে চায় দেশের লাগিয়া, মন টানে তার গেহ।

কোথা গৃহহারা, স্নেহহারা ওরে ছন্নছাড়ার দল –
যাদের কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে টলমল।
পিছনে চাওয়ার নাহি যার কেউ, নাই পিতামাতা জ্ঞাতি
তারা তো আসে না জ্বালাইতে মোর আঁধার কবরে বাতি!
আঁধারে থাকিয়া, বন্ধু, দিব্যদৃষ্টি গিয়াছে খুলে
আমি দেখিয়াছি তোমাদের বুকে ভয়ের যে ছায়া দুলে।
তোমরা ভাবিছ – আমি বাহিরিলে তোমরা ছুটিবে পিছে –
আপনাতে নাই বিশ্বাস যার – তাহার ভরসা মিছে!

আমি যদি মরি সমুখ-সমরে – তবু যারা টলিবে না –
যুঝিবে আত্মশক্তির বলে তারাই অমর সেনা।
সেই সেনাদল সৃষ্টি যেদিন হইবে – সেদিন ভোরে
মোমের প্রদীপ নহে গো – অরুণ সূর্য দেখিব গোরে!
প্রতীক্ষারত শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া আমি
সেই যে পরম ক্ষণের লাগিয়া জেগে আছি দিবা-যামী।
ভয়কে যাহারা ভুলিয়াছে – সেই অভয় তরুণ দল
আসিবে যেদিন – হাঁকিব সেদিন – ‘সময় হয়েছে, চল!’

আমি গেলে যারা আমার পতাকা ধরিবে বিপুল বলে –
সেই সে অগ্রপথিকের দল এসো এসো পথতলে!
সেদিন মৌন সমাধিমগ্ন ইসরাফিলের বাঁশি
বাজিয়া উঠিবে – টুটিবে দেশের তমসা সর্বনাশী!

অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি

চরণারবিন্দে লহো অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি,
হে রবীন্দ্র, তব দীন ভক্ত এ কবির।
অশীতি-বার্ষিকী তব জনম-উৎসবে
আসিয়াছি নিবেদিতে নীরব প্রণাম।
হে কবিসম্রাট, ওগো সৃষ্টির বিস্ময়,
হয়তো হইনি আজও করুণাবঞ্চিত!
সঞ্চিত যে আছে আজও স্মৃতির দেউলে
তব স্নেহ করুণা তোমার, মহাকবি!
ধ্যান-শান্ত মৌন তব কাব্য-রবিলোকে
সহসা আসিনু আমি ধূমকেতুসম
রুদ্রের দুরন্ত দূত, ছিন্ন হর-জটা,
কক্ষচ্যুত উপগ্রহ! বক্ষে ধরি তুমি
ললাট চুমিয়া মোর দানিলে আশিস!
দেখেছিল যারা শুধু মোর উগ্ররূপ,
অশান্ত রোদন সেথা দেখেছিলে তুমি!
হে সুন্দর, বহ্নিদগ্ধ মোর বুকে তাই
দিয়াছিলে ‘বসন্তের’ পুষ্পিত মালিকা!
একা তুমি জানিতে হে, কবি মহাঋষি,
তোমারই বিচ্যুত-ছটা আমি ধূমকেতু!
আগুনের ফুলকি হল ফাগুনের ফুল,
অগ্নি-বীণা হল ব্রজকিশোরের বেণু।
শিব-শিরে শশিলেখা হল ধূমকেতু,
দাহ তার ঝরিলো গো অশ্রু-গঙ্গা হয়ে।

বিশ্ব-কাব্যলোকে কবি, তব মহাদান
কত যে বিপুল, কত যে অপরিমাণ
বিচার করিতে আমি যাব না তাহার,
মৃৎভাণ্ড মাপিবে কি সাগরের জল?
যতদিন রবে রবি, রবে সৌরলোক,
হে সুন্দর, ততদিন তব রশ্মিলেখা
দিব্যজ্যোতিঃ পুষ্প গ্রহ-তারকার মতো
অসীম গগনে রবে নিত্য সমুজ্জ্বল!
ছন্দায়িত হবে ছন্দে সৃষ্টি যতদিন,
ছন্দ-ভারতীর পায়ে বাণীর নূপুর
ঝংকারিবে যতদিন বৃষ্টিধারাসম
ততদিন মধুচ্ছন্দা করি, ছন্দ তব
লীলায়িত হবে মধুমতী-স্রোত সম।
বিহগের কন্ঠে গীত রবে যতদিন,
যতদিন রবে সুর দখিনা পবনে,
হিল্লোলিত সিন্ধুজলে ঝরনা-তটিনীতে,
বহিবে বিরহী-বুকে রোদন-প্রবাহ –
ততদিন তব গান তব সুর কবি
মর্মরিবে মরমির মরমে মরমে!
মৌনা যদি কোনোদিন হয় বীণাপাণি
তব বীণা কবি কভু হবে না নীরব।
যেমন ছড়ান রশ্মি সূর্য-নারায়ণ
সেই রশ্মি রূপ নেয় শত শত রঙে
পল্লবে ও ফুলে ফলে জলে স্থলে ব্যোমে,
তেমনই দেখেছি আমি বিমুগ্ধ নয়নে
অপরূপ রাগ-রেখা তোমার লেখায়, –
মুরছিত হইয়াছে আবেশে এ তনু।

দেখেছি তোমারে যবে হইয়াছে মনে
তুমি চিরসুন্দরের পরম বিলাস!
মানুষ এ পৃথিবীতে অন্তরে বাহিরে
কত সে উদার কত নির্মল মধুর
কত প্রিয়-ঘন প্রেমরসসিক্ত তনু
কত সে সুন্দর হতে পারে সর্বরূপে
তাই প্রকাশের তরে পরম সুন্দর
বিগ্রহ তোমার গড়েছিল ওগো কবি!
যখনই কবিতা তব পড়িয়াছি আমি
তার আস্বাদনে যেন হয়ে গেছি লয়,
রস পান করে আমি হয়ে গেছি রস,
বলিতে পারি না তাই সে রস কেমন।
তোমারে দেখিতে গিয়া দেখিয়াছি আমি
বক্ষে তব চির-রূপ-রসবিলাসীরে!
হারায়ে ফেলেছি সেথা সত্তা আপনার
কাঁদিয়াছি রূপমুগ্ধা রাধিকার মতো।
হে কবি, আজিও শুনি সে চির-কিশোর
তোমার বেণুতে গাহে যৌবনের গান।
সেথা তুমি কবি নও, ঋষি নহ তুমি,
সেথা তুমি মোর প্রিয় পরম সুন্দর!

শুনি আজও কত শত পাথরের ঢেলা
তোমারে নিষ্ঠুর বলে, বলে – প্রেম নাই।
মেঘের হুংকার শুধু শুনিল তাহারা,
দেখিল না রসধারা, দেখিল বিদ্যুৎ!
এ বিশ্বে অনন্ত রস ঝরে অনুক্ষণ
কত জন পাইয়াছে সে রসের স্বাদ?
সেই রসে তরুলতা হয় ফুলময়,
পাথরের নুড়ি বলে, পৃথিবী নীরস।

হে প্রেম-সুন্দর মম, আমি নাহি জানি
কে কত পেয়েছে তব প্রেম-রসধারা।
আমি জানি, তব প্রেম আমার আগুন
নিভায়ে, দিয়াছে সেথা কান্তি অপরূপ।
মনে পড়ে? বলেছিলে হেসে একদিন,
‘তরবারি দিয়ে তুমি চাঁছিতেছ দাড়ি!
যে জ্যোতি করিতে পারে জ্যোতির্ময় ধরা
সে জ্যোতিরে অগ্নি করি হলে পুচ্ছ-কেতু?’
হাসিয়া কহিলে পরে, ‘এই যশ-খ্যাতি
মাতালের নিত্য সান্ধ্য নেশার মতন।
এ মজা না পেলে মন ম্যাজম্যাজ করে
মধুর ভৃঙ্গারে কেন কর মদ্যপান?’

যে বহ্নিতরঙ্গ উঠেছিল মোর মাঝে
তোমার পরশে তাহা হল চন্দ্র-জ্যোতি।
মনে হল তুমি সেই নওলকিশোর
ঐশ্বর্য কাড়িয়া যিনি দেন শুধু রস।
যাঁহার বেণুর সুরে আঁখির পলকে
প্রেমে বিগলিত হয় স্বর্ণ-বৃন্দাবন!

হে রসশেখর কবি, তব জন্মদিনে
আমি কয়ে যাব মোর নব জন্মকথা!
আনন্দসুন্দর তব মধুর পরশে
অগ্নিগিরি গিরি-মল্লিকার ফুলে ফুলে
ছেয়ে গেছে! জুড়ায়েছে সব দাহজ্বালা!
আমার হাতের সেই খর তরবারি
হইয়াছে খরতর যমুনার বারি!
দ্রষ্টা তুমি দেখিতেছ আমাতে যে জ্যোতি
সে জ্যোতি হয়েছে লীন কৃষ্ণঘনরূপে!
অভিনন্দনের মদ চন্দনিত মধু
হইয়াছে, হে সুন্দর, তব আশীর্বাদে!

আজ আমি ভুলে গেছি আমি ছিনু কবি,
ফুটেছি কমল হয়ে তব করে রবি!
প্রস্ফুটিত সে কমল তব জন্মদিনে
সমর্পিনু শ্রীচরণে, লহো কৃপা করি
জানি না জীবনে মোর এই শুভদিন
আবার আসিবে ফিরে কবে কোন লোকে!
আমি জানি মোর আগে রবি নিভিবে না
তার আগে ঝরে যেন যাই শতদল!

আজাদ

কোথা সে আজাদ? কোথা সে পূর্ণ-মুক্ত মুসলমান?
আল্লাহ্ ছাড়া করে না কারেও ভয়, কোথা সেই প্রাণ?
কোথা সে ‘আরিফ’ , কোথা সে ইমাম, কোথা সে শক্তিধর?
মুক্ত যাহার বাণী শুনি কাঁদে ত্রিভুবন থরথর!
কে পিয়েছে সে তৌহিদ-সুধা পরমামৃত হায়?
যাহারে হেরিয়া পরান পরম শান্তিতে ডুবে যায়।
আছে সে কোরান-মজিদ আজিও পরম শক্তিভরা,
ওরে দুর্ভাগা, এক কণা তার পেয়েছিস কেউ তোরা?
সেই যে নামাজ রোজা আছে আজও, আজও সে কলমা আছে,
আজও উথলায় আব-জমজম কাবা শরিফের কাছে।
নামাজ পড়িয়া, রোজা রেখে আর কলমা পড়িয়া সবে
কেন হতেছিস দলে দলে তোরা কতলগাহেতে জবেহ?
সব আছে, তবু শবের মতন ভাগাড়ে পড়িয়া কেন?
ভেবেছ কি কেউ কৌমের পির, নেতা; কেন হয় হেন?
আজিও তেমনই জামায়েত হয় ঈদ্গাহে মসজিদে,
ইমাম পড়েন খোৎবা, শ্রোতার আঁখি ঢুলে আসে নিদে!
যেন দলে দলে কলের পুতুল, শক্তি শৌর্যহীন,
নাহিকো ইমাম, বলিতে হইবে – ইহারা মুসলেমিন!
পরম পূর্ণ শক্তি-উৎস হইতে জনম লয়ে
কেমন করিয়া শক্তি হারাল এ জাতি? কোন সে ভয়ে
তিলে তিলে মরে, মানুষের মতো মরিতে পারে না তবু?
আল্লাহ্ যার প্রভু ছিল, আজ শয়তান তার প্রভু!
খুঁজিয়া দেখিনু, মুসলিম নাই, কেবল কাফেরে ভরা,-
কাফের তারেই বলি, যারে ঢেকে আছে শত ভীতিজরা।
অজ্ঞান-অন্ধকার যাহারে রেখেছে আবৃত করি,
নিত্য সূর্য জ্বলে, তবু যার পোহাল না বিভাবরী!
আল্লাহ্ আর তাহার মাঝারে কোনো আবরণ নাই,
এই দুনিয়ায় মুসলিম সেই – দেখেছ তাহারে ভাই?
আল্লার সাথে নিত্য-যুক্ত পরম শক্তিধর,
এই মুসলিম-কবরস্তানে পেয়েছ তার খবর?
চায় নাকো যশ, চায় নাকো মান, নিত্য নিরভিমান,
নিরহংকার আসক্তিহীন – সত্য যাহার প্রাণ;
জমায় না যে বিত্ত নিত্য মুসাফির গৃহহীন,
আশমান যার ছত্র ধরেছে, পাদুকা যার জমিন;
দিনে আর রাতে চেরাগ যাহার চন্দ্র সূর্য তারা,
আহার যাহার আল্লার নাম – প্রেমের অশ্রুধারা?

যার পানে চায় – সেই যেন পায় তখনই অমৃত বারি,
যাহারে ডাকে – সে অমনি তাহার সাথে চলে সব ছাড়ি?
অনন্ত জনগণ মাঝে পারে শক্তি সঞ্চারিতে,
যারে স্পর্শ করে সে অমনি ভরে ওঠে অমৃতে।
সেই সে পূর্ণ মুসলমান, সে পূর্ণ শক্তিধর,
‘উম্মি’ হয়েও জয় করিতে সে পারে এই চরাচর!
যে দিকে তাকাই দেখি যে কেবলই অন্ধ বদ্ধ জীব,
ভোগোন্মত্ত, পঙ্গু, খঞ্জ, আতুর, বদ-নসিব।
কাগজে লিখিয়া, সভায় কাঁদিয়া গুম্ফ শ্মশ্রু ছিঁড়ে,
আছে কেউ নেতা, লবে ইহাদের অমৃত-সাগরতীরে
আসে অনন্ত শক্তি নিয়ত যে মূল-শক্তি হতে
সেখান হইতে শক্তি আনিয়া ভাসাতে শক্তি-স্রোতে–
কোন তপস্বী করিছে সাধনা? বন্ধু, বৃথা এ শ্রম,
নিজে যার ভ্রম ভাঙেনি সেই কি ভাঙাবে জাতির ভ্রম?
দোজখের পথে, ধ্বংসের পথে চলিয়াছে সারা জাতি,
শূন্য দু-হাত, ‘পাইয়াছি’ বলে তবু করে মাতামাতি!

সেদিন এমনই মাতালের সাথে পথে মোর হল দেখা,
শুধানু, ‘কী পেলে?’ সে বলে, দেখো না, কপালে রয়েছে লেখা?
কপালের পানে চাহিয়া আমার নয়নে আসিল বারি,
বাদশাহ হতে পারিত যে হায়, পেয়েছে সে জমাদারি!
দলে দলে আসে, কারও বুকে, কারও পেটে, কারও হাতে লেখা,
আজাদির চিন্ – অর্থাৎ কিনা চাকুরির মসিলেখা!
কাঁদিয়া কহিনু, – ওরে বে-নসিব, হতভাগ্যের দল,
মুসলিম হয়ে জনম লভিয়া এই কি লভিলি ফল?
অন্যেরে দাস করিতে, কিংবা নিজে দাস হতে, ওরে
আসেনিকো দুনিয়ায় মুসলিম, ভুলিলি কেমন করে?
ভাঙিতে সকল কারাগার, সব বন্ধন ভয় লাজ
এল যে কোরান, এলেন যে নবি, ভুলিলি সে সব আজ?
হায় গণ-নেতা ভোটের ভিখারি নিজের স্বার্থ তরে
জাতির যাহারা ভাবী আশা, তারে নিতেছ খরিদ করে।
সারা জাতি সারারাতি জেগে আছে যাহাদের পানে চেয়ে,
যে তরুণ দল আসিছে বাহিরে জ্ঞানের মানিক পেয়ে –
তাহাদের ধরে গোলাম করিয়া ভরিতেছ কার ঝুলি?
চা-বাগানের আড়কাঠি যেন চালান করিছ কুলি!
উহারা তরুণ, জানে না উহারা, কেন লভিল এ জ্ঞান,
তপস্যা করি জাগাবে উহারা ভারত-গোরস্তান!
ওদের আলোকে আলোকিত হবে অন্ধকার এ দেশ,
ওদেরই শৌর্যে ত্যাগে মহিমায় ঘুচিবে দীনের ক্লেশ।

তুমি চাকরির কশাইখানায় ঘুরিছ তাদেরে লয়ে,
তুমি কি জান না, ওখানে যে যায় – সে যায় জবেহ্ হয়ে?
দেখিতেছ না কি শিক্ষিত এই বাঙালির দুর্দশা,
মানুষ যে হত, চাকরি করিয়া হয়েছে সে আজ মশা।
ভিক্ষা করিয়া মরুক উহারা, ক্ষুধা তৃষ্ণায় জ্বলে –
সমবেত হোক ধ্বংস-নেশায় মুক্ত আকাশতলে।
আগুন যে বুকে আছে – তাতে আরও দুখ-ঘৃতাহুতি দাও,
বিপুল শক্তি লয়ে ওরা হোক জালিম-পানে উধাও
যে ইস্পাতে তরবারি হয়, আঁশ-বটি করো তারে!
অন্ধ, খঞ্জ, জরাগ্রস্ত নিজেরা অন্ধকারে
ঘুরিয়া মরিছ, তাই কি চাহিছ সবাই অন্ধ হোক?
কৌম জাতির প্রাণ বেচে তুমি হইতেছ বড়োলোক।…

আজাদ-আত্মা! আজাদ-আত্মা! সাড়া দাও, দাও সাড়া!
এই গোলামির জিঞ্জির ধরে ভীম বেগে দাও নাড়া!
হে চির-অরুণ তরুণ, তুমি কি বুঝিতে পারনি আজও?
ইঙ্গিতে তুমি বৃদ্ধ সিন্ধবাদের বাহন সাজ!
জরারে পৃষ্ঠে বহিয়া বহিয়া জীবন যাবে কি তব,
জীবন ভরিয়া রোজা রাখি ঈদ আনিবে না অভিনব?
ঘরে ঘরে তব লাঞ্ছিতামাতা ভগ্নীরা চেয়ে আছে,
ওদের লজ্জা-বারণ শক্তি আছে তোমাদেরই কাছে।
ঘরে ঘরে মরে কচি ছেলেমেয়ে দুধ নাহি পেয়ে হায়,
তোমরা তাদেরে বাঁচাবে না আজ বিলাইয়া আপনায়?
আজ মুখ ফুটে দল বেঁধে বলো, বলো ধনীদের কাছে,
ওদের বিত্তে এই দরিদ্র দীনের হিস্‌সা আছে!
ক্ষুধার অন্নে নাই অধিকার ; সঞ্চিত যার রয়,
সেই সম্পদে ক্ষুধিতের অধিকার আছে নিশ্চয়।
মানুষেরে দিতে তাহার ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার
ইসলাম এসেছিল দুনিয়ায়, যারা কোরবান তার –
তাহাদেরই আজ আসিয়াছে ডাক – বেহেশ্‌ত-পার হতে,
আনন্দ লুট হবে দুনিয়ায় মহা-ধ্বংসের পথে –
প্রস্তুত হও – আসিছেন তিনি অভয় শক্তি লয়ে –
আল্লাহ্‌ থেকে আবে-কওসর নবীন বার্তা বয়ে।
অন্তরে আর বাহিরে নিত্য আজাদমুক্ত যারা,–
নব-জেহাদের নির্ভীক দুর্বার সেনা হবে তারা,
আমাদেরই আনা নিয়ামত পেয়ে খাবে আর দেবে গালি,
জেহাদের রণে নওশা সাজিয়া মোরা দিব হাততালি!
বলিব বন্ধু, মিটেছে কি ক্ষুধা, পেয়েছ কি কওসর?
বেহেশ্‌তে হবে তকবির ধ্বনি, আল্লাহু আকবর!
জিন্নাৎ হতে দেখিব মোদের গোরস্তানের পর
প্রেমে আনন্দে পূর্ণ সেথায় উঠেছে নূতন ঘর।

আমার কবিতা তুমি

প্রিয়া-রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আঁখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি!
জুড়াল গো তার শত জনমের রৌদ্রদগ্ধ-কায়া–
এতদিনে পেল তার স্বপনের স্নিগ্ধ মেঘের ছায়া!
চেয়ে দেখো প্রিয়া, তোমার পরশ পেয়ে
গোলাপ দ্রাক্ষাকুঞ্জে মরুর বক্ষ গিয়াছে ছেয়ে!

গভীর নিশীথে, হে মোর মানসী, আমার কল্পলোকে
কবিতার রূপে চুপে চুপে তুমি বিরহ-করুণ চোখে
চাহিয়া থাকিতে মোর মুখ পানে ; আসিয়া হিয়ার মাঝে
বলিতে যেন গো – ‘হে মোর বিরহী, কোথায় বেদনা বাজে?’
আমি ভাবিতাম, আকাশের চাঁদ বুকে বুঝি এল নেমে
মোর বেদনায় বুকে বুক রাখি কাঁদিতে গভীর প্রেমে!
তব চাঁদ-মুখপানে চেয়ে আজ চমকিয়া উঠি আমি,
আমি চিনিয়াছি, সে চাঁদ এসেছে প্রিয়া-রূপ ধরে নামি!

যত রস-ধারা নেমেছে আমার কবিতার সুরে গানে
তাহার উৎস কোথায়, হে প্রিয়া, তব শ্রীঅঙ্গ জানে।
তাই আজ তব যে অঙ্গে যবে আমার নয়ন পড়ে,
থির হয়ে যায় দৃষ্টি সেথাই, আঁখি-পাতা নাহি নড়ে!
তোমার তনুর অণু-পরমাণু চির-চেনা মোর, রানি!
তুমি চেন নাকো ওরা চেনে বলে, ‘বন্ধু তোমারে জানি।’
অনন্ত শ্রীকান্তি লাবণি রূপ পড়ে ঝরে ঝরে
তোমার অঙ্গ বাহি, প্রিয়তমা, বিশ্ব ভুবন-পরে!
মন্ত্র-মুগ্ধ সাপের মতন তোমার অঙ্গ পানে
তাই চেয়ে থাকি অপলক-আঁখি, লজ্জারে নাহি মানে!

তুমি যবে চল, যবে কথা বল, মুখ পানে চাও হেসে
মূর্তি ধরিয়া ওঠে যেন সেথা আমার ছন্দ ভেসে।
মনে মনে বলি, তুমি যে আমার ছন্দ-সরস্বতী,
ওগো চঞ্চলা, আমার জীবনে তুমি দুরন্ত গতি!
আমার রুদ্র নৃত্যে জেগেছে কঙ্কালে নব প্রাণ,
ছন্দিতা ওগো, আমি জানি, তাহা তব অঙ্গের দান!
নাচ যবে তুমি আমার বক্ষে, রুধির নাচিয়া ওঠে
সেই নাচ মোর কবিতায় গানে ছন্দ হইয়া ফোটে।
মনে পড়ে যবে তোমার ডাগর সজল-কাজল আঁখি,
সে চোখের চাওয়া আমার গানের সুর দিয়ে বেঁধে রাখি।
প্রেম-ঢলঢল তোমার বিরহ-ছলছল মুখ হেরি
ভাবের ইন্দ্রধনু ওঠে মোর সপ্ত আকাশ ঘেরি।
আমার লেখার রেখায় রেখায় ইন্দ্রধনুর মায়া,
উহারা জানে না, এই রং তব তনুর প্রতিচ্ছায়া!
আমার লেখায় কী যেন গভীর রহস্য খোঁজে সবে
ভাবে, এ কবির প্রিয়তমা বুঝি আকাশ-কুসুম হবে!
উহারা জানে না, তুমি অসহায় কাঁদ পৃথিবীর পথে,
উহারা জানে না রহস্যময়ী তুমি মোর লেখা হতে।

আমিই ধরিতে পারি না তোমারে, উহারা ধরিতে চায়,
সাগরের স্মৃতি খুঁজে ওরা মরুভূর বালুকায়!
তোমার অধরে আঁখি পড়ে যবে, অধীর তৃষ্ণা জাগে,
মোর কবিতায় রস হয়ে সেই তৃষ্ণার রং লাগে।
জাগে মদালস-অনুরাগ-ঘন নব যৌবন-নেশা
এই পৃথিবীরে মনে হয় যেন শিরাজি আঙুর-পেশা!
সুর হয়ে ওঠে সুরা যেন, আমি মদিরা-মত্ত হয়ে
যৌবন-বেগে তরুণেরে ডাকি খর তরবারি লয়ে।
জরাগ্রস্ত জাতিরে শুনাই নব জীবনের গান,
সেই যৌবন-উন্মদ বেগ, হে প্রিয়া তোমার দান।
হে চির-কিশোরী, চির-যৌবনা! তোমার রূপের ধ্যানে
জাগে সুন্দর রূপের তৃষ্ণা নিত্য আমার প্রাণে।
আপনার রূপে আপনি মুগ্ধা দেখিতে পাও না তুমি
কত ফুল ফুটে ওঠে গো তোমার চরণ-মাধুরী চুমি!
কুড়ায়ে সে ফুল গাঁথি আমি মালা কাব্যে-ছন্দে-গানে,
মালা দেখে সবে, জানে না মালার ফুল ফোটে কোনখানে!

হে প্রিয়া, তোমার চির-সুন্দর রূপ বারে বারে মোরে
অসুন্দরের পথ হতে টানি আনিয়াছে হাত ধরে।
ভিড় করে যবে ঘিরিত আমারে অসুন্দরের দল,
সহসা ঊর্ধ্বে ফুটিয়া উঠিত তব মুখ-শতদল।
মনে হত, যেন তুমি অনন্ত শ্বেত শতদল-মাঝে,
মোর প্রতীক্ষা করিতেছ প্রিয়া চির-বিরহিণী সাজে।
সেই মুখখানি খুঁজিয়া ফিরেছি পৃথিবীর দেশে দেশে,
শ্রান্ত স্বপনে হৃদয়ে-গগনে ও মুখ উঠিত ভেসে!
যেই ধরিয়াছি মনে হত হায়, অমনই ভাঙিত ঘুম,
স্মৃতি রেখে যেত আমার আকাশে তব রূপ-কুঙ্কুম!
দেখি নাই, তবু কহিতাম গানে ‘সাড়া দাও, সাড়া দাও,
যারা আসে পথে, তারা তুমি নহ, ওদের সরায়ে নাও!’
ভেবেছিনু, বুঝি পৃথিবীতে আর তব দেখা মিলিল না,
তুমি থাক বুঝি সুদূর গগনে হয়ে কবি-কল্পনা।
সহসা একদা প্রভাতে যখন পাখিরা ছেড়েছে নীড়,
হারানো প্রিয়ারে খুঁজেছি আকাশে অরুণ-চন্দ্রাপীড়,
আমি পৃথিবীতে খুঁজিতেছিনু গো আমার প্রিয়ারে গানে,
থমকি দাঁড়ানু, চমকি উঠিনু কাহার বীণার তানে!
বেণু আর বীণা এক সাথে বাজে কাহার কন্ঠ-তটে,
কার ছবি যেন কাঁদিয়া উঠিল লুকানো হৃদয়-পটে।
হেরিনু আকাশে তরুণ সূর্য থির হয়ে যেন আছে,
কে যেন কী কথা কয়ে গেল হেসে আমার কানের কাছে।
আমার বুকের জমাট তুষার-সাগর সহসা গলে
আছাড়িয়া যেন পড়িতে চাহিল তোমার চরণ-তলে।
ওগো মেঘ-মায়া, বুঝিয়াছিলে কি তুমি?
দারুণ তৃষায় তব পানে ছিল চেয়ে কোনো মরুভূমি?
তুমি চলে গেলে ছায়ার মতন, আমি ভাবিলাম মায়া,
কল্প-লোকের প্রিয়া আসে না গো ধরণিতে ধরি কায়া!

ভেবেছিনু, আর জীবনে হবে না দেখা –
সহসা শ্রাবণ-মেঘ এল যেন হইয়া ব্রজের কেকা!
যমুনার তীরে বাজিয়া উঠিল আবার বিরহী বেণু,
আঁধার কদম-কুঞ্জে হেরিনু রাধার চরণ-রেণু।
যোগ-সমাধিতে মগ্ন আছিনু, ভগ্ন হইল ধ্যান,
আমার শূন্য আকাশে আসিল স্বর্ণ-জ্যোতির বান।
চির-চেনা তব মুখখানি সেই জ্যোতিতে উঠিল ভাসি
ইঙ্গিতে যেন কহিলে, ‘বিরহী প্রিয়তম, ভালোবাসি!’
আমি ডাকিলাম, ‘এসো এসো তবে কাছে।’
কাঁদিয়া কহিলে, ‘হেরো গ্রহ তারা এখনও জাগিয়া আছে,
উহারা নিভুক, ঘুমাক পৃথিবী, ঘুমাক রবি ও শশী,
সেদিন আমারে পাবে গো, লাজের গুন্ঠন যাবে খসি।
কেবল দুজন করিব কূজন, রহিবে না কোনো ভয়,
মোদের ভুবনে রহিবে কেবল প্রেম আর প্রেমময়।’

‘আমি কী করিব?’ কহিলাম আঁখি-নীরে
কহিলে ‘কাঁদিবে মোর নাম লয়ে বিরহ-যমুনাতীরে!
যমুনা শুকায়ে গিয়াছে প্রেমের গোকুলে এ ধরাতলে,
আবার সৃজন করো সে যমুনা তোমার অশ্রুজলে।
তোমার আমার কাঁদন গলিয়া হইবে যমুনা জল
সেই যমুনায় সিনান করিতে আসিবে গোপিনীদল,
ওরা প্রেম পাবে, পাইবে শান্তি, পাবে তৃষ্ণার মধু,
তোমারে দিলাম চির-উপবাস, পরম বিরহ, বঁধু!’
‘এ কী অভিশাপ দিলে তুমি’ বলে যেমনই উঠি গো কাঁদি,
হেরি কাঁদিতেছ পাগলিনি মোর হাত দুটি বুকে বাঁধি!
আজ মোর গানে কবিতায়, সুরে তুমি ছাড়া নাই কেউ,
সেই অভিশাপ যমুনায় বুঝি তুলেছে বিপুল ঢেউ!
সবার তৃষ্ণা মিটাইতে আমি যমুনা হইয়া ঝরি,
জানে না পৃথিবী, কোন নিদারুণ তৃষ্ণা লইয়া মরি!
বড়ো জ্বালা বুকে, বলো বলো প্রিয়া – না-ই পাইলাম কাছে,
এই বিরহের পারে তব প্রেম আছে আজও জেগে আছে!
যদি অভিমান জাগে মোর বুকে না বুঝে তোমার খেলা,
দূরে থাক বলে ভাবি যদি তারে অনাদর অবহেলা –
কেঁদে কেঁদে রাতে যদি মোর হাতে লেখনী যায় গো থামি,
বিরহ হইয়া বুকে এসে মোর কহিয়ো – ‘এই তো আমি।’

আর কতদিন?

আমার দিলের নিদ-মহলায় আর কতদিন, সাকি,
শারাব পিয়ায়ে, জাগায়ে রাখিবে, প্রীতম আসিবে নাকি?
অপলক চোখে চাহি আকাশের ফিরোজা পর্দা-পানে,
গ্রহতারা মোর সেহেলিরা নিশি জাগে তার সন্ধানে।
চাঁদের চেরাগ ক্ষয় হয়ে এল ভোরের দর-দালানে,
পাতার জাফরি খুলিয়া গোলাপ চাহিছে গুলিস্তানে।
রবাবের সুরে অভাব তাহার বৃথাই ভুলিতে চাই,
মন যত বলে আশা নাই, হৃদে তত জাগে ‘আশনাই’।
শিরাজি পিয়ায়ে শিরায় শিরায় কেবলই জাগাও নেশা,
নেশা যত লাগে অনুরাগে, বুকে তত জাগে আন্দেশা।

আমি ছিনু পথ – ভিখারিনি, তুমি কেন পথ ভুলাইলে,
মুসাফিরখানা ভুলায়ে আনিলে কোন এই মঞ্জিলে?
মঞ্জিলে এনে দেখাইলে কার অপরূপ তসবির,
‘তসবি’তে জপি যত তাঁর নাম তত ঝরে আঁখি-নীর!
‘তশবিহি’ রূপ এই যদি তাঁর, ‘তনজিহি’ কীবা হয়,
নামে যাঁর এত মধু ঝরে, তাঁর রূপ কত মধুময়।
কোটি তারকার কীলক-রুদ্ধ অম্বর-দ্বার খুলে
মনে হয় তার স্বর্ণ-জ্যোতি দুলে উঠে কুতুহলে।
ঘুম-নাহি-আসা নিঝঝুম নিশি-পবনের নিশ্বাসে
ফিরদৌস-আলা হতে যেন লাল ফুলের সুরভি আসে।
চামেলি জুঁই-এর পাখায় কে যেন শিয়রে বাতাস করে,
শ্রান্তি ভুলাতে কী যেন পিয়ায় চম্পা-পেয়ালা ভরে।

শিস দেয় দধিয়াল বুলবুলি, চমকিয়া উঠি আমি,
ইঙ্গিতে বুঝি কামিনী-কুঞ্জে ডাকিলেন মোর স্বামী।
নহরের পানি লোনা হয়ে যায় আমার অশ্রুজলে,
তসবির তাঁর জড়াইয়া ধরি বক্ষের অঞ্চলে!
সাকি গো! শারাব দাও, যদি মোর খারাব করিলে দীন,
‘আল-ওদুদের’ পিয়ালার দৌর চলুক বিরাম-হীন।
গেল জাতি কুল শরম ভরম যদি এসে এই পথে
চালাও শিরাজি, যেন নাহি জাগি আর এ বে-খুদী হতে
দূর গিরি হতে কে ডাকে, ওকি মোর কোহ-ই-তুর-ধারী?
আমারই মতো কি ওরই ডাকে মুসা হল মরু-পথচারী?
উহারই পরম রূপ দেখে ইশা হল না কি সংসারী?
মদিনা-মোহন আহমদ ওরই লাগি কি চির-ভিখারি?
লাখো আউলিয়া দেউলিয়া হল যাহার কাবা দেউলে,
কত রূপবতী যুবতি যাহার লাগি কালি দিল কুলে,
কেন সেই বহু-বিলাসীর প্রেমে, সাকি, মোরে মজাইলি,
প্রেম-নহরের কওসর বলে আমারে জহর দিলি?

জান সাকি, কাল মাটির পৃথিবী এসেছিল মোর কাছে,
আমি শুধালাম, মোর প্রিয়তম, সে কি পৃথিবীতে আছে?
‘খাক’ বলিল, না, জানি না তো আমি,‘আব’ বুঝি তাহা জানে
জলেরে পুছিনু, তুমি কি দেখেছ মোর বঁধু কোনখানে?
আমার বুকের তসবির দেখে জল করে টলমল,
জল বলে, আমি এরই লাগি কাঁদি গলিয়া হয়েছি জল।
আগুন হয়তো তেজ দিয়া এরে বক্ষে রেখেছে ঘিরে,
সূর্যের ঘরে প্রবেশিনু আমি তেজ-আবরণ ছিঁড়ে।
হেরিনু সূর্য সাত-ঘোড়া নিয়ে সাত আশমানে ছুটে,
সহসা বঁধুর তসবির হেরে আমার বক্ষ-পুটে।
বলিল, কোথায় দেখেছ ইহারে, হইয়াছে পরিচয়?
ইহারই প্রেমের আগুনে জ্বলিয়া তনু হল মোর ক্ষয়।
যুগযুগান্ত গেল কত তবু মিটিল না এই জ্বালা।
ইহারই প্রেমের জ্বালা মোর বুকে জ্বলে হয়ে তেজোমালা।

যেতে যেতে পথে দেখিনু বাতাস দীরঘ নিশাস ফেলি
খুঁজিতেছে কারে আকাশ জুড়িয়া নীল অঞ্চল মেলি।
মোর বুকে দেখে তসবির এল ছুটিয়া ঝড়ের বেগে,
বলে – অনন্ত কাল ছুটে ফিরি দিকে দিকে এরই লেগে।
খুঁজিয়া স্থূল ও সূক্ষ্ম জগতে পাইনি ইহার দিশা,
তুমি কোথা পেলে আমার প্রিয়ের এই তসবির-শিশা?
হাসিয়া উঠিনু ব্যোম-পথে, সেথা কেবল শব্দ ওঠে
অলখ-বাণীর পারাবারে যেন শত শতদল ফোটে।
আমি কহিলাম, দেখেছ ইহারে হে অলক্ষ্য বাণী?
বাণীর সাগর কত অনন্ত হল যেন কানাকানি!
‘নাহি জানি নাহি জানি’ বলে ওঠে অনন্ত ক্রন্দন,
বলে, হে বন্ধু, জানিলে টুটিত বাণীর এ বন্ধন।–
জ্যোতির মোতির মালা গলে দিয়া সহসা স্বর্ণরথে
কে যেন হাসিয়া ছুঁইয়া আমারে পলাল অলখ-পথে।

‘ও কি জৈতুনি রওগন, ওরই পারে জলপাই-বনে
আমার পরম-একাকী বন্ধু খেলে কি গো নিরজনে?’
শুধানু তাহারে ; নিষ্ঠুর মোর দিল নাকো উত্তর?
জাগিয়া দেখিনু, অঙ্গ আবেশে কাঁপিতেছে থরথর!…

জোহরা-সেতারা উঠেছে কি পুবে? জেগে উঠেছে কি পাখি?
সুরার সুরাহি ভেঙে ফেলো সাকি, আর নিশি নাই বাকি।
আসিবে এবার আমার পরম বন্ধুর বোররাক
ওই শোনো পুব-তোরণে তাহার রঙিন নীরব ডাক!

ঈদের চাঁদ

সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ
চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা;
মোদের হিস্‌সা আদায় করিতে ঈদে
দিল হুকুম আল্লাতালা!
দ্বার খোলো সাততলা-বাড়িওয়ালা, দেখো কারা দান চাহে,
মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেব ঈদ্গাহে!
আনিয়াছে নবযুগের বারতা নতুন ঈদের চাঁদ,
শুনেছি খোদার হুকুম, ভাঙিয়া গিয়াছে ভয়ের বাঁধ।
মৃত্যু মোদের ইমাম সারথি, নাই মরণের ভয়;
মৃত্যুর সাথে দোস্তি হয়েছে – অভিনব পরিচয়।
যে ইসরাফিল প্রলয়-শিঙ্গা বাজাবেন কেয়ামতে–
তাঁরই ললাটের চাঁদ আসিয়াছে, আলো দেখাইতে পথে।
মৃত্যু মোদের অগ্রনায়ক, এসেছে নতুন ঈদ,
ফিরদৌসের দরজা খুলিব আমরা হয়ে শহিদ।
আমাদের ঘিরে চলে বাংলার সেনারা নৌজোয়ান,
জানি না, তাহারা হিন্দু কি ক্রিশ্চান কি মুসলমান।
নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই –
জুলুমের জিন্দানে জনগণে আজাদ করিতে চাই!
এক আল্লার সৃষ্ট সবাই, এক সেই বিচারক,
তাঁর সে লীলার বিচার করিবে কোন ধার্মিক বক?
বকিতে দিব না বকাসুরে আর, ঠাসিয়া ধরিব টুঁটি
এই ভেদ-জ্ঞানে হারায়েছি মোরা ক্ষুধার অন্ন রুটি।
মোরা শুধু জানি, যার ঘরে ধনরত্ন জমানো আছে,
ঈদ আসিয়াছে, জাকাত আদায় করিব তাদের কাছে।
এসেছি ডাকাত জাকাত লইতে, পেয়েছি তাঁর হুকুম,
কেন মোরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরিব, সহিব এই জুলুম?
যক্ষের মতো লক্ষ লক্ষ টাকা জমাইয়া যারা
খোদার সৃষ্ট কাঙালে জাকাত দেয় না, মরিবে তারা।
ইহা আমাদের ক্রোধ নহে, ইহা আল্লার অভিশাপ,
অর্থের নামে জমেছে তোমার ব্যাঙ্কে বিপুল পাপ।
তাঁরই ইচ্ছায় – ব্যাঙ্কের দিকে চেয়ো না – ঊর্ধ্বে চাহো,
ধরার ললাটে ঘনায় ঘোলাটে প্রলয়ের বারিবাহ!
আল্লার ঋণ শোধ করো, যদি বাঁচিবার থাকে সাধ ;
আমাদের বাঁকা ছুরি আঁকা দেখো আকাশে ঈদের চাঁদ!
তোমারে নাশিতে চাষার কাস্তে কী রূপ ধরেছে, দেখো,
চাঁদ নয়, ও যে তোমার গলার ফাঁদ! দেখে মনে রেখো!
প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে, আজীবন উপবাসী,
তাহাদেরই তরে এই রহমত , ঈদের চাঁদের হাসি।
শুধু প্রজাদের জমায়েত হবে আজিকার ঈদ্গাহে,
কাহার সাধ্য, কোন ভোগী রাক্ষস সেথা যেতে চাহে?
ভেবো না ভিক্ষা চাহি মোরা, নহে শিক্ষা এ আল্লার,
মোরা প্রতিষ্ঠা করিতে এসেছি আল্লার অধিকার!
এসেছে ঈদের চাঁদ বরাভয় দিতে আমাদের ভয়ে,
আবার খালেদ এসেছে আকাশে বাঁকা তলোয়ার লয়ে!
কঙ্কালে আজ ঝলকে বজ্র, পাষাণের জাগরণ,
লাশে উল্লাস জেগেছে রুদ্র উদ্ধত যৌবন!
দারিদ্র্য-কারবালা-প্রান্তরে মরিয়াছি নিরবধি,
একটুকু কৃপা করনি, লইয়া টাকার ফোরাত নদী।
কত আসগর মরিয়াছে, জান, এই বাপ মা-র বুকে?
সকিনা মরেছে, তোমরা দখিনা বাতাস খেয়েছ সুখে!
শহিদ হয়েছে হোসেন, কাসেম, আসগর, আব্বাস,
মানুষ হইয়া আসিয়াছি মোরা তাঁদের দীর্ঘশ্বাস!
তোমরাও ফিরে এসেছ এজিদ সাথে লয়ে প্রেত-সেনা,
সেবারে ফিরিয়া গিয়াছিলে, জেনো, আজ আর ফিরিবে না।
এক আল্লার সৃষ্টিতে আর রহিবে না কোনো ভেদ,
তাঁর দান কৃপা কল্যাণে কেহ হবে না না-উম্মেদ !
ডাকাত এসেছে জাকাত লইতে, খোলো বাক্‌সের চাবি!
আমাদের নহে, আল্লার দেওয়া ইহা মানুষের দাবি!
বাঁচিবে না আর বেশিদিন রাক্ষস লোভী বর্বর,
টলেছে খোদার আসন টলেছে, আল্লাহু-আকবর!
সাত আশমান বিদারি আসিছে তাঁহার পূর্ণ ক্রোধ।
জালিমে মারিয়া করিবেন মজলুমের প্রাপ্য শোধ।