শাত-ইল-আরব

শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
শহীদের লোহু, দিলিরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর।
যুঝেছে এখানে তুর্কি-সেনানী,
য়ুনানি, মিস্‌রি, আর্‌বি, কেনানি–
লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ্‌ বেদুঈন্‌দের চাঙ্গা শির!
নাঙ্গা-শির্–
শম্‌শের হাতে, আঁসু-আঁখে হেথা মূর্তি দেখেছি বীর-নারীর!
শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
‘কুত-আমারা’র রক্তে ভরিয়া
দজ্‌লা এনেছে লোহুর দরিয়া;
উগারি সে খুন তোমাতে দজ্‌লা নাচে ভৈরব ‘মস্তানি’র।
এস্তা-নীর
গর্জে রক্ত-গঙ্গা ফোরাত, –’শাস্তি দিয়েছি গোস্তাখির!’
দজ্‌লা-ফোরাত-বাহিনী শাতিল! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
বহায়ে তোমার লোহিত বন্যা
ইরাক আজমে করেছ ধন্যা;–
বীর-প্রসূ দেশ হলো বরেণ্যা মরিয়া মরণ মর্দমির!
মর্দ বীর
সাহারায় এরা ধুঁকে মরে তবু পরে না শিকল পদ্ধতির।

শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব্! পূত যুগে যুগে তোমার তীর!
দুশ্‌মন্-লোহু ঈর্ষায়-নীল
তব তরঙ্গে করে ঝিলমিল্,
বাঁকে বাঁকে রোষে মোচড় খেয়েছ পিয়ে নীল খুন পিণ্ডারির!
জিন্দা বীর

‘জুলফিকার’ আর ‘হায়দরি’ হাঁক হেথা আজো হজরত্ আলীর-
শাতিল্-আরব!-শাতিল্-আরব!! জিন্দা রেখেছে তোমার তীর।
ললাটে তোমার ভাস্বর টীকা
বস্‌রা-গুলের বহ্নিতে লিখা–
এ যে বসোরার খুন-খারাবি গো রক্ত-গোলাব-মঞ্জরীর!
খঞ্জরীর
খঞ্জরে ঝরে খর্জুর সম হেথা লাখো দেশ-ভক্ত-শির!
শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব!! পূত যুগে তোমার তীর।
ইরাক-বাহিনী! এ যে গো কাহিনী,–
কে জানিত কবে বঙ্গ-বাহিনী
তোমারও দুঃখে ‘জননী আমার!’ বলিয়া ফেলিবে তপ্ত নীর!
রক্ত-ক্ষীর–
পরাধীনা! একই ব্যথায় ব্যথিত ঢালিল দু-ফোঁটা ভক্ত-বীর।
শহীদের দেশ! বিদায়! বিদায়!! এ অভাগা আজ নোয়ায় শির!
—————————–
শাতিল আরব– আরব দেশের একটি নদীর নাম।
দিলির– অসম সাহসী
য়ুয়ানি– য়ুনান দেশের অধিবাসী
মিস্‌রিা– মিশরের অধিবাসী
কেনানি– কেনানের অধিবাসী
চাঙ্গা– টাটকা
কুত-আমারা–
কুতল-আমার নামক স্থান, যেখানে জেনারেল টাউনসেন্ড বন্দী হন।

কোরবানি

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,–
আজিকার এ খুন কোর্‌বানির!
দুম্বা-শির রুম্-বাসীর
শহীদের শির-সেরা আজি। –রহমান কি রুদ্র নন?
বাস্‍! চুপ খামোশ রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর ‘খুন দে, জান দে, শির দে বৎস’ শোন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
খঞ্জর মারো গর্দানেই,
পঞ্জরে আজি দরদ নেই,
মর্দানি’ই পর্দা নেই
ডর্‌তা নেই আজ খুন্-খারাবিতে রক্ত-লুব্ধ মন!
খুনে খেল্‌ব খুন্-মাতন!
দুনো উন্মাদনাতে সত্য মুক্তি আন্‌তে যুঝ্‌র রণ।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
চড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার
মুস্‌লিমে সারা দুনিয়াটার।
‘জুল্‌ফেকার’ খুল্‌বে তার
দু’ধারী ধার্‌ শেরে-খোদার রক্তে-পূত-বদন!
খনে আজকে রুধ্‌ব মন!
ওরে শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,
‘আজাদি’ মেলে না পস্তানোয়!
দস্তা নয় সে সস্তা নয়!
হত্যা নয় কি মৃত্যুও? তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্
কাঁদে-শক্তি-দুঃস্থ শোন্–

‘এয়্‌ ইব্‌রাহিম্ আজ কোর্‌বানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন!’
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
এ তো নহে লোহু তরবারের
ঘাতক জালিম জোর্‌বারের!
কোরবানের জোর-জানের
খুন এ যে, এতে গোর্দা ঢের রে, এ ত্যাগে ‘বুদ্ধ’ মন!
এতে মা রাখে পুত্র পণ্!
তাই জননী হাজেরা বেটারে পরাল বলির পূত বসন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
এই দিনই ‘মীনা’-ময়দানে
পুত্র-স্নেহের গর্দানে
ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে
রেখেছে আব্বা ইব্‌রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!
ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন!
আজ জল্লাদ নয়, প্রহলাদ সম মোল্লা খুন-বদন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
দ্যাখ্ কেঁপেছে ‘আরশ’ আস্‌মানে,
মন-খুনি কি রে রাশ মানে?
ত্রাস প্রাণে?-তবে রাস্তা নে‍!
প্রলয়- বিষাণ কিয়ামতে তবে বাজাবে কোন্ বোধন?
সেকি সৃষ্টি-সংশোধন?
ওরে তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!–
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
মুস্‌লিম-রণ-ডঙ্কা সে,
খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?
টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে
ওরে হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম কারা লড়ব রণ-মরণ!
ঢালে বাজ্‌বে ঝন্-ঝনন!
ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
জোর চাই আর যাচ্‌না নয়
কোরবানি-দিন আজ না ওই?
বাজ্‌না কই? সাজ্‌না কই?
কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?
বল্– ‘যুঝ্‌ব জান্ ভি পণ!’
ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ!
আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
———————————–
রহমান– করুণাময়
খামোশ– নীরব।
গর্দানে– স্কন্ধে
জান্নাত– স্বর্গ
জুলফেকার– মহাবীর হজরত আলীর বিশ্বত্রাস তরবারি
শের-খোদা– খোদার সিংহ; হজরত আলীকে এই গৌরাবান্বিত নামে অভিহিত করা হয়।
জোরবার– বলদৃপ্ত
জোর-জান– মহাপ্রাণ
আজাদি– মুক্তি
আব্বা– বাবা
ইবরাহিম– Abraham
হাজেরা– হজরত ইবরাহীমের স্ত্রী

মোহর্‌রম

নীল সিয়া আসমা লালে লাল দুনিয়া,–
‘আম্মা ! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’।
কাঁদে কোন্ ক্রদসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে !
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া দামেশকে–
‘জয়নালে পরাল এ খুনিয়ারা বেশ কে?
‘হায় হায় হোসেনা’ ওঠে রোল ঝন্‌ঝায়,
তল্‌ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায়!
উন্‌মাদ ‘দুলদুল্’ ছুটে ফেরে মদিনায়,
আলি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়!
মা ফাতেমা আস্‌মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস!
রণে যায় কাসিম্ ঐ দু’ঘড়ির নওশা,
মেহেদির রঙটুকু মুছে গেল সহসা!
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা–
‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেলো সকিনা!’
কাঁদে কে রে কোলে করে কাসিমের কাটা-শির?
খান্‌খান্ খুন হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর!
কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার!
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্‌মনও ‘সাব্বাস’!
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা!’
মা’র থনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্‌পায়!
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়্‌টায়?
দাউদাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু–’পানি দাও, মরে জাদু আস্‌গর!’
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ খাঁ করে কার্‌বালা, নাই পানি খর্জুর,
পেল না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, –পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্!
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাঁধনে!
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
‘দাদা! তেরি হর্ কিয়া বর্‌বাদ্ পয়মাল!’
হাইদরি-হাঁক হাঁকি দুল্‌দুল্-আস্‌ওয়ার
শম্‌শের চম্‌কায় দুশমনে ত্রাস্‌বার!
খসে পড়ে হাত হতে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার।
নিঃশেষ দুশ্‌মন্; ওকে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত?
কোথা বাবা আস্‌গর্? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসনের ফেটে যায় পাঁজরা!
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয়নি রে বাছাদের মুখে কম্‌জাত্‌রা!
অঞ্জলি হতে পানি পড়ে গেল ঝর্-ঝর্
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জর!
হল্‌কুমে হানে তেগ ও কে বসে ছাতিতে?–
আফ্‌তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে!
আস্‌মান ভরে গেল গোধূলিতে দুপরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে!
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্–
‘আরশের পায়া ধরে কাঁদে মাতা ফাতেমা,
‘এয়্ খোদা বদ্‌লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জনা করো গোনা পাপী কম্‌বখ্‌তের!’
কত মোহর্‌রম্ এল্ গেল চলে বহু কাল–
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুস্‌লিম্! তোরা আজ জয়নাল আবেদিন,
‘ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এল আজ সেই মোহর্‌রম মাহিনা,–
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!
উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবির,
দুনিয়াতে নত নয় মুস্‌লিম কারো শির;–
তবে শোনো ঐ শোনো বাজে কোথা দামামা,
শম্‌শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকিবের তূর্য,
হুশিয়ার ইস্‌লাম, ডুবে তব সূর্য!
জাগো ওঠো মুস্‌লিম, হাঁকো হাইদরি হাঁক।
শহীদের দিনে সব-লালে-লাল হয়ে যাক!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তিন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন।
হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের;
আস্‌গর সম দিব বাচ্চারে কোর্‌বান,
জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান!
সকিনার শ্বেতবাস দেব মাতা কন্যায়,
কাসিমের মতো দেবো জান রুধি অন্যায়!
মোহর্‌রম্! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’
দেখো মরু-সূর্যে এ খুন যেন শোষে না!

———————————–
আরশ–খোদার সিংহাসন।
আম্মা –মা।
লা’ল–জাদু।
মাতম –হাহা ক্রন্দন।
দুনিয়া-দামেশকে– দামেশক-রূপ দুনিয়ায়।
আমামা–শিরস্ত্রাণ।

বানু –আসগরের মাতা।
আসগর –ইমাম হোসেনের শিশুপুত্র।
জয়নাল –ইমাম হোসেনের পুত্র।
বরবাদ –নষ্ট।
পয়মাল –ধ্বংস।
দুলদুল-আসওয়ার –’দুলদুল’ ঘোড়ার সওয়ার ইমাম হোসেন।
এক কাৎরা –এক বিন্দু।
কমজাতরা –নীচমনাগণ।
হলকুম –কণ্ঠ।
তেগ –তরবারি।
আফতাব –সূর্য।
কমবখ্‌ত –হতভাগ্য

মর্সিয়া –শোক-গীতি।
শম্‌শের –তরবারি।
নকিব –তূর্যবাদক।
জহর –বিষ।
কহর –অভিশাপ।
দাদ –প্রতিশোধ।

প্রভাতী

ভোর হোলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!

ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুল-খুকী ছোট রে!

রবি মামা
দেয় হামা
গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান
গায় গান
শোনো ঐ, ‘রামা হৈ!’

ত্যাজি’ নীড়
ক’রে ভিড়
ওড়ে পাখী আকাশে,
এন্তার
গান তার
ভাসে ভোর বাতাসে!

চুল বুল
বুল বুল
শিস দেয় পুস্পে,

এইবার
এইবার
খুকুমনি উঠবে!

খুলি’হাল
তুলি’ পাল
ঐ তরী চল লো,

এইবার
এইবার
খুকু চোখ খুললো!

আলসে
নয় সে
ওঠে রোজ সকালে,

রোজ তাই
চাঁদা ভাই
টিপ দেয় কপালে।

উঠল
ছুটল
ঐ খোকাখুকী সব,

‘উঠেছে
আগে কে’
ঐ শোনো কলরব।

নাই রাত
মুখ হাত
ধোও, খুকু জাগো রে!
জয়গানে
ভগবানে
তুমি’বর মাগো রে!

সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ

হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে চির-বিরহী,
হে অতৃপ্ত! রহি’ রহি’
কোন্‌ বেদনায়
উদ্বেলিয়া ওঠ তুমি কানায় কানায়?
কি কথা শুনাতে চাও, কারে কি কহিবে বন্ধু তুমি?
প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে উর্ধ্বে নীলা নিম্নে বেলা-ভুমি!
কথা কও, হে দুরন্ত, বল,
তব বুকে কেন এত ঢেউ জাগে, এত কলকল?
কিসের এ অশান্ত গর্জন?
দিবা নাই রাত্রি নাই, অনন্ত ক্রন্দন
থামিল না, বন্ধু, তব!
কোথা তব ব্যথা বাজে! মোরে কও, কা’রে নাহি ক’ব!
কা’রে তুমি হারালে কখন্‌?
কোন্‌ মায়া-মণিকার হেরিছ স্বপন?
কে সে বালা? কোথা তার ঘর?
কবে দেখেছিলে তারে? কেন হ’ল পর
যারে এত বাসিয়াছ ভালো!
কেন সে আসিল, এসে কেন সে লুকালো?
অভিমান ক’রেছে সে?
মানিনী ঝেপেছে মুখ নিশীথিনী-কেশে?
ঘুমায়েছে একাকিনী জোছনা-বিছানে?
চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে
তোমার সাগর-প্রাণ, জাগায় জোয়ার?
কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার?
বল, বন্ধু বল,
ও কি গান? ওকি কাঁদা? ঐ মত্ত জল-ছলছল-
ও কি হুহুঙ্কার?
ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার?
টানিয়া সে মেঘের আড়াল
সুদূরিকা সুদূরেই থাকে চিরকাল?
চাঁদের কলঙ্ক ঐ, ও কি তব ক্ষুধাতুর চুম্বনের দাগ?
দূরে থাকে কলঙ্কিনী, ও কি রাগ? ও কি অনুরাগ?
জান না কি, তাই
তরঙ্গে আছাড়ি’ মর আক্রোশে বৃথাই?….
মনে লাগে তুমি যেন অনন্ত পুরুষ
আপনার স্বপ্নে ছিলে আপনি বেহুঁশ!
অশান্ত! প্রশান্ত ছিলে
এ-নিখিলে
জানিতে না আপনারে ছাড়া।
তরঙ্গ ছিল না বুকে, তখনো দোলানী এসে দেয়নি ক’ নাড়া!
বিপুল আরশি-সম ছিলে স্বচ্ছ, ছিলে স্থির,
তব মুখে মুখ রেখে ঘুমাইত তীর।–

তপস্বী! ধেয়ানী!
তারপর চাঁদ এলো-কবে, নাহি জানি
তুমি যেন উঠিলে শিহরি’।
হে মৌনী, কহিলে কথা-“মরি মরি,
সুন্দর সুন্দর!”
“সুন্দর সুন্দর” গাহি’ জাগিয়া উঠিল চরাচর!
সেই সে আদিম শব্দ, সেই আদি কথা,
সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা,
সেই বুঝি বুঝিলে রাজন্‌
একা সে সুন্দর হয় হইলে দু’জন!
কোথা সে উঠিল চাঁদ হৃদয়ে না নভে
সে-কথা জানে না কেউ, জানিবে না, চিরকাল নাহি-জানা র’বে।
এতদিনে ভার হ’ল আপনারে নিয়া একা থাকা,
কেন যেন মনে হয়-ফাঁকা, সব ফাঁকা
কে যেন চাহিছে মোরে, কে যেন কী নাই,
যারে পাই তারে যেন আরো পেতে চাই!

জাগিল আনন্দ-ব্যথা, জাগিল জোয়ার,
লাগিল তরঙ্গে দোলা, ভাঙিল দুয়ার,
মাতিয়া উঠিলে তুমি!
কাঁপিয়া উঠিল কেঁদে নিদ্রাতুরা ভূমি!
বাতাসে উঠিল ব্যেপে তব হতাশ্বাস,
জাগিল অন্তত শূন্যে নীলিমা-উছাস!
রোমাঞ্চিত হ’ল ধরা,
বুক চিরে এল তার তৃণ-ফুল-ফল।
এল আলো, এল বায়ু, এল তেজ প্রাণ,
জানা ও অজানা ব্যেপে ওঠে সে কি অভিনব গান!
এ কি মাতামাতি ওগো এ কি উতরোল!
এত বুক ছিল হেথা, ছিল এত কোন!
শাখা ও শাখীতে যেন কত জানাশোনা,
হাওয়া এসে দোলা দেয়, সেও যেন ছিল জানা
কত সে আপনা!
জলে জলে ছলাছলি চলমান বেগে,
ফুলে হুলে চুমোচুমি-চরাচরে বেলা ওঠে জেগে!
আনন্দ-বিহ্বল
সব আজ কথা কহে, গাহে গান, করে কোলাহল!
বন্ধু ওগো সিন্ধুরাজ! স্বপ্নে চাঁদ-মুখ
হেরিয়া উঠিলে জাগি’, ব্যথা ক’রে উঠিল ও-বুক।
কী যেন সে ক্ষুধা জাগে, কী যেন সে পীড়া,
গ’লে যায় সারা হিয়া, ছিঁড়ে যায় যত স্নায়ু শিরা!
নিয়া নেশা, নিয়া ব্যথা-সুখ
দুলিয়া উঠিলে সিন্ধু উৎসুক উন্মুখ!
কোন্‌ প্রিয়-বিরহের সুগভীর ছায়া
তোমাতে পড়িল যেন, নীল হ’ল তব স্বচ্ছ কায়া!
সিন্ধু, ওগো বন্ধু মোর!
গর্জিয়া উঠিল ঘোর
আর্ত হুহুঙ্কারে!
বারে বারে
বাসনা-তরঙ্গে তব পড়ে ছায়া তব প্রেয়সীর,
ছায়া সে তরঙ্গে ভাঙে, হানে মায়া, উর্ধ্ব প্রিয়া স্থির!
ঘুচিল না অনন্ত আড়াল,
তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদি সাথে কাল!
কাঁদে গ্রীষ্ম, কাঁদে বর্ষা, বসন্ত ও শীত,
নিশিদিন শুনি বন্ধু ঐ এক ক্রন্দনের গীত,
নিখিল বিরহী কাঁদে সিন্ধু তব সাথে,
তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে প্রিয়া রাতে!
সেই অশ্রু-সেই লোনা জল
তব চক্ষে — হে বিরহী বন্ধু মোরা — করে টলমল!
এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া
তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া।

চট্টগ্রাম ২৯/০৭/১৯২৬

সিন্ধুঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ

হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর
হে মোর বিদ্রোহী!
রহি’ রহি’
কোন্‌ বেদনায়
তরঙ্গ-বিভঙ্গে মাতো উদ্দাম লীলায়!
হে উন্মত্ত, কেন এ নর্তন?
নিষ্ফল আক্রোশে কেন কর আস্ফালন
বেলাভূমে পড়ো আছাড়িয়া!
সর্বগ্রাসী! গ্রাসিতেছ মৃত্যু-ক্ষুধা নিয়া
ধরণীরে তিলে-তিলে!
হে অস্থির! স্থির নাহি হ’তে দিলে
পৃথিবীরে! ওগো নৃত্য-ভোলা,
ধরারে দোলায় শূন্যে তোমার হিন্দোলা!
হে চঞ্চল,
বারে বারে টানিতেছ দিগন্তিকা-বন্ধুর অঞ্চল!
কৌতুকী গো! তোমার এ-কৌতুকের অন্ত যেন নাই।-
কী যেন বৃথাই
খুঁজিতেছ কূলে কূলে
কার যেন পদরেখা!-কে নিশীথে এসেছিল ভুলে
তব তীরে, গর্বিতা সে নারী,
যত বারি আছে চোখে তব
সব দিলে পদে তার ঢালি’,
সে শুধু হাসিল উপক্ষায়!
তুমি গেলে করিতে চুম্বন, সে ফিরালো কঙ্কণের ঘায়!
–গেল চ’লে নারী!
সন্ধান করিয়া ফের, হে সন্ধানী, তারি
দিকে দিকে তরণীর দুরাশা লইয়া,
গর্জনে গর্জনে কাঁদ–“পিয়া, মোর পিয়া!’’

বলো বন্ধু, বুকে তব কেন এত বেগ, এত জ্বালা?
কে দিল না প্রতিদিন? কে ছিঁড়িল মালা?
কে সে গরবিনী বালা? কার এত রূপ এত প্রাণ,
হে সাগর, করিল তোমার অপমান!
হে মজনু, কোন্‌ সে লায়লীর
প্রণয়ে উন্মাদ তুমি?-বিরহ-অথির
করিয়াছে বিদ্রোহ ঘোষণা, সিন্ধুরাজ,
কোন্‌ রাজকুমারীর লাগি’? কারে আজ
পরাজিত করি’ রণে, তব প্রিয়া রাজ-দুহিতারে
আনিবে হরণ করি?-সারে সারে
দলে দলে চলে তব তরঙ্গের সেনা,
উষ্ণীষ তাদের শিরে শোভে শুভ্র ফেনা!
ঝটিকা তোমার সেনাপতি
আদেশ হানিয়া চলে উর্ধ্বে অগ্রগতি।
উড়ে চলে মেঘের বেলুন,
‘মাইন্‌’ তোমার চোরা পর্বত নিপুণ!
হাঙ্গর কুম্ভীর তিমি চলে ‘সাবমেরিন’,
নৌ-সেনা চলিছে নীচে মীন!
সিন্ধু-ঘোটকেতে চড়ি’ চলিয়াছ বীর
উদ্দাম অস্থির!
কখন আনিবে জয় করি’-কবে সে আসিবে তব প্রিয়া,
সেই আশা নিয়া
মুক্তা-বুকে মালা রচি’ নীচে!
তোমার হেরেম্‌-বাঁদী শত শুক্তি-বধূ অপেক্ষিছে।
প্রবাল গাঁথিছে রক্ত-হার-
হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর-তোমার প্রিয়ার!
বধূ তব দীপাম্বীতা আসিবে কখন?
রচিতেছে নব নব দ্বীপ তারি প্রমোদ-কানন।
বক্ষে তব চলে সিন্ধু-পোত
ওরা তব যেন পোষা কপোতী-কপোত।
নাচায়ে আদর করে পাখীরে তোমার
ঢেউ-এর দোলায়, ওগো কোমল দুর্বার!
উচ্ছ্বাসে তোমার জল উলসিয়া উঠে,
ও বুঝি চুম্বর তব তা’র চঞ্চুপুটে?
আশা তব ওড়ে লুব্ধ সাগর-শকুন,
তটভূমি টেনে চলে তব আশা-তারকার গুণ!
উড়ে যায় নাম-নাহি-জানা কত পাখী,
ও যেন স্বপন তব!-কী তুমি একাকী
ভাব কভু আনমনে যেন,
সহসা লুকাতে চাও আপনারে কেন!
ফিরে চলো ভাঁটি-টানে কোন্‌ অন্তরালে,
যেন তুমি বেঁচে যাও নিজেরে লুকালে!-
শ্রান্ত মাঝি গাহে গান ভাটিয়ালী সুরে,
ভেসে যেতে চায় প্রাণ দূরে-আরো দূরে।
সীমাহীন নিরুদ্দেশ পথে,
মাঝি ভাসে, তুমি ভাস, আমি ভাসি স্রোতে।

নিরুদ্দেশ! শুনে কোন্‌ আড়ালীর ডাক
ভাটিয়ালী পথে চলো একাকী নির্বাক?
অন্তরের তলা হ’তে শোন কি আহবান?
কোন্‌ অন্তরিকা কাঁদে অন্তরালে থাকি’ যেন,
চাহে তব প্রাণ!
বাহিরে না পেয়ে তারে ফের তুমি অন্তরের পানে
লজ্জায়-ব্যথায়-অপমানে!
তারপর, বিরাট পুরুষ! বোঝা নিজ ভুল
জোয়ারে উচ্ছ্বসি’ ওঠো, ভেঙে চল কূল
দিকে দিকে প্লাবনের বাজায়ে বিষাণ
বলো, ‘ প্রেম করে না দুর্বল ওরে করে মহীয়ান্‌!’
বারণী সাকীরে কহ, ‘ আনো সখি সুরার পেয়ালা!’
আনন্দে নাচিয়া ওঠো দুখের নেশায় বীর, ভোল সব জ্বালা!
অন্তরের নিষ্পেষিত ব্যথার ক্রন্দন
ফেনা হ’য়ে ওঠে মুখে বিষর মতন।
হে শিব, পাগল!
তব কন্ঠে ধরি’ রাখো সেই জ্বালা-সেই হলাহল!
হে বন্ধু, হে সখা,
এতদিনে দেখা হ’ল, মোরা দুই বন্ধু পলাতকা।

কত কথা আছে-কত গান আছে শোনাবার,
কত ব্যথা জানাবার আছে-সিন্ধু, বন্ধু গো আমার!
এসো বন্ধু, মুখোমুখি বসি,
অথবা টানিয়া লহ তরঙ্গের আলিঙ্গন দিয়া, দুঁহু পশি
ঢেউ নাই যেথা-শুধু নিতল সুনীল!-
তিমির কহিয়া দাও-সে যেন খোলে না খিল
থাকে দ্বারে বসি’,
সেইখানে ক’ব কথা। যেন রবি-শশী
নাহি পশে সেথা।
তুমি র’বে-আমি র’ব-আর র’বে ব্যথা!
সেথা শুধু ডুবে র’বে কথা নাহি কহি’,-
যদি কই,-
নাই সেথা দু’টি কথা বই,
আমিও বিরহী, বন্ধু, তুমিও বিরহী!’

চট্টগ্রাম ৩১/০৭/১৯২৬

সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ

হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তৃষিত জলধি,
এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি!
এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান,
বুভুক্ষু! তবু কি তব ভরলি না প্রাণ?
দুরন্ত গো, মহাবাহু
ওগো রাহু,
তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী!
সুরা নাই-পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকী!

হে দুর্গম! খোলো খোলো খোলো দ্বার।
সারি সারি গিরি-দরী দাঁড়ায়ে দুয়ারে করে প্রতীক্ষা তোমার।
শস্য-শ্যামা বসুমতী ফুলে-ফলে ভরিয়া অঞ্জলি
করিছে বন্দনা তব, বলী!
তুমি আছ নিয়া নিজ দুরন্ত কল্লোল
আপনাতে আপনি বিভোল!
পাশে না শ্রবণে তব ধরণীতে শত দুঃখ-গীত;
দেখিতেছ বর্তমান, দেখেছ অতীত,
দেখিবে সুদূরে ভবিষ্যৎ-
মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রষ্টা, ঋষি, উদাসীনবৎ!
ওঠে ভাঙে তব বুকে তরঙ্গের মতো
জন্ম-মৃত্যু দুঃখ-সুখ, ভূমানন্দে হেরিছ সতত!

হে পবিত্র! আজিও সুন্দর ধরা, আজিও অম্লান
সদ্য-ফোটা পুষ্পসম, তোমাতে করিয়া নিতি স্নান!
জগতের যত পাপ গ্লানি
হে দরদী, নিঃশেষে মুছিয়া লয় তব স্নেহ-পাণি!
ধরা তব আদরিনী মেয়ে,
তাহারে দেখিতে তুমি আস’ মেঘ বেয়ে!
হেসে ওঠে তৃণে-শস্যে দুলালী তোমার,
কালো চোখ বেয়ে ঝরে হিম-কণা আনন্দাশ্রু-ভরা!
জলধারা হ’য়ে নামো, দাও কত রঙিন যৌতুক,
ভাঙ’ গড়’ দোলা দাও,-
কন্যারে লইয়া তব অনন্ত কৌতুক!
হে বিরাট, নাহি তব ক্ষয়,
নিত্য নব নব দানে ক্ষয়েরে ক’রেছ তুমি জয়!

হে সুন্দর! জলবাহু দিয়া
ধরণীর কটিতট আছো আঁকড়িয়া
ইন্দ্রানীলকান্তমণি মেখলার সম,
মেদিনীর নিতম্ব সাথে দোল’ অনুপম!
বন্ধু, তব অনন্ত যৌবন
তরঙ্গে ফেনায়ে ওঠে সুরার মতন!
কত মৎস্য-কুমারীরা নিত্য তোমা’ যাচে,
কত জল-দেবীদের শুষ্ক মালা প’ড়ে তব চরণের কাছে,
চেয়ে নাহি দেখ, উদাসীন!
কার যেন স্বপ্নে তুমি মত্ত নিশিদিন!

মন্থর-মন্দার দিয়া দস্যু সুরাসুর
মথিয়া লুন্ঠিয়া গেছে তব রত্ন-পুর,
হরিয়াছে উচ্চেঃশ্রবা, তব লক্ষ্মী, তব শশী-প্রিয়া
তার সব আছে আজ সুখে স্বর্গে গিয়া!
ক’রেছে লুন্ঠন
তোমার অমৃত-সুধা-তোমার জীবন!
সব গেছে, আছে শুধু ক্রন্দন-কল্লোল,
আছে জ্বালা, আছে স্মৃতি, ব্যথা-উতরোল
উর্ধ্বে শূন্য, নিম্নে শূন্য,-শূন্য চারিধার,
মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার!

হে মহান! হে চির-বিরহী!
হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে মোর বিদ্রোহী,
সুন্দর আমার!
নমস্কার!
নমস্কার লহ!
তুমি কাঁদ,-আমি কাঁদি,-কাঁদে মোর প্রিয়া অহরহ।
হে দুস্তর, আছে তব পার, আছে কূল,
এ অনন্ত বিরহের নাহি পার–নাহি কূল–শুধু স্বপ্ন, ভুল।
মাগিব বিদায় যবে, নাহি র’ব আর,
তব কল্লোলের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আমার!
বৃথাই খুঁজিবে যবে প্রিয়
উত্তরিও বন্ধু ওগো সিন্ধু মোর, তুমি গরজিয়া!
তুমি শূন্য, আমি শূন্য, শূন্য চারিধার,
মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার।

চট্টগ্রাম ৩১/০৭/১৯২৬

দারিদ্র্য

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্‌।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!

দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!
শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!

বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম,
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল

টলটল ধরণীর মত করুণায়!
তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়
করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি
ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’
সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল
কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল?
জ্বালা নাই, নেশা নাই. নাই উন্মাদনা,-
রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা
এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে,
তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে।
কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা,
দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!….

গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!….

ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি
ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি
সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন,
হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্‌,
ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো,
অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো,
আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার,
তাই এবে কর্‌ ভোগ!-পড়ে হাহাকার
নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি,
কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি!

চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু,
কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু,
দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ,
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান,
প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,-
তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!

বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ,
তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।
সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু,
উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু।
মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে
গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে!
নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে
সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে!

লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’
ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী?
যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি!

প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই
বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই
আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’!
বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে
আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্‌
মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….

শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’
বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্‌ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।

উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ!
আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান
আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি
পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী
কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে!
পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে
ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার।
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!-
সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু
জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু
কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!

পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?
কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!….

আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই, কিছু নাই!

২৪শে আশ্বিন ১৩৩৩

ফাল্গুনী

সখি পাতিসনে শিলাতলে পদ্মপাতা,
সখি দিসনে গোলাব-ছিটে খাস্‌ লো মাথা!
যার অন্তরে ক্রন্দন
করে হৃদি মন্থন
তারে হরি-চন্দন
কমলী মালা-
সখি দিসনে লো দিসনে লো, বড় সে জ্বালা!
বল কেমনে নিবাই সখি বুকের আগুন!
এল খুন-মাখা তৃণ নিয়ে খু’নেরা ফাগুন!
সে যেন হানে হুল্‌-খুনসুড়ি,
ফেটে পড়ে ফুলকুঁড়ি
আইবুড়ো আইবুড়ো
বুকে ধরে ঘুণ!
যত বিরহিণী নিম্‌-খুন-কাটা ঘায়ে নুন!

আজ লাল-পানি পিয়ে দেখি সব-কিছু চুর!
সবে আতর বিলায় বায়ু বাতাবি নেবুর!
হ’ল মাদার আশোক ঘা’ল,
রঙন তো নাজেহাল!
লালে লাল ডালে-ডাল
পলাশ শিমুল!
সখি তাহাদের মধু ক্ষরে-মোরে বেঁধে হুল্‌!

নব সহকার-মঞ্জরী সহ ভ্রমরী!
চুমে ভোমরা নিপট, হিয়া মরে গুমরি’।
কত ঘাটে ঘাটে সই-সই
ঘট ভরে নিতি ওই,
চোখে মুখে ফোটে খই,-
আব-রাঙা গাল,
যত আধ-ভাঙা ইঙ্গিত তত হয় লাল!

আর সইতে পারিনে সই ফুল-ঝামেলা!
প্রাতে মল্লী চাঁপা, সাঁজে বেলা চামেলা!
হের ফুটবো মাধী হুরী
ডগমগ তরুপুরী,
পথে পথে ফুলঝুরি
সজিনা ফুলে!
এত ফুল দেখে কুলবালা কূল না ভুলে!

সাজি’ বাটা-ভরা ছাঁচিপান ব্যজনী-হাতে
করে স্বজনে বীজন কত সজনী ছাতে!
সেথা চোখে চোখে সঙ্কেত
কানে কথা-যাও ধেৎ,-
ঢ’লে-পড়া অঙ্কেতে
মন্‌মথ-ঘায়!
আজ আমি ছাড়া আর সবে মন-মত পায়।

সখি মিষ্টি ও ঝাল মেশা এল এ কি বায়!
এ যে বুক যত জ্বালা করে মুখ তত চায়!
এযে শরাবের মতো নেশা
এ পোড়া মলয় মেশা,
ডাকে তাহে কুলনাশা
কালামুখো পিক।
যেন কাবাব করিতে বেঁধে কলিজাতে শিক্‌!

এল আলো-রাধা ফাগ ভরি’ চাঁদের থালায়
ঝরে জোছনা-আবীর সারা শ্যাম সুষমায়!
যত ডাল-পালা নিম্‌খুন,
ফুলে ফুলে কুঙ্কুম্‌,
চুড়ি বালা রুম্‌ঝুম,
হোরির খেলা,
শুধু নিরালায় কেঁদে মরি আমি একেলা!

আজ সঙ্কেত-শঙ্কিত বন-বীথিকায়
কত কুলবধূ ছিঁড়ে শাড়ি কুলের কাঁটায়!
সখি ভরা মোর এ দু’কুল
কাঁটাহীন শুধু ফুল!
ফুলে এত বেঁধে হুল?
ভালো ছিল হায়,
সখি ছিঁড়িত দু’কূল যদি কুলের কাঁটায়!

হুগলী, ফাল্গুন ১৩৩২

বধূ বরণ

এতদিন ছিলে ভূবনের তুমি
আজ ধরা দিলে ভবনে,
নেমে এলে আজ ধরার ধূলাতে
ছিলে এতদিন স্বপনে!
শুধু শোভাময়ী ছিলে এত দিন
কবির মানসে কলিকা নলিন,
আজ পরশিলে চিত্ত- পুলিন
বিদায় গোধূলি- লগনে।
ঊষার ললাট-সিন্দুর-টিপ
সিথিঁতে উড়াল পবনে।।

প্রভাতে ঊষা কুমারী, সেজেছে
সন্ধ্যায় বধূ ঊষসী,
চন্দন- টোপা- তারা- কলঙ্কে
ভ’রেছে বে-দাগ- মু’শশী।
মুখর মুখ আর বাচাল নয়ন
লাজ সুখে আজ যাচে গুন্ঠন,
নোটন- কপোতি কন্ঠে এখন
কূজন উঠিছে উছসি’।
এতদিন ছিলে শুধু রূপ- কথা,
আজ হ’লে বধূ রূপসী।।

দোলা চঞ্চল ছিল এই গেহ
তব লটপট বেণী ঘা’য়,
তারি সঞ্চিত আনন্দে ঝলে
ঐ ঊর- হার মনিকায়।
এ ঘরের হাসি নিয়ে যাও চোখে,
সে গৃহ- দ্বীপ জ্বেলো এ আলোকে,
চোখের সলিল থাকুক এ-লোকে-
আজি এ মিলন মোহানায়
ও- ঘরের হাসি বাশিঁর বেহাগ
কাঁদুক এ ঘরে সাহানায়।।

বিবাহের রঙ্গে রাঙ্গা আজ সব,
রাঙ্গা মন, রাঙ্গা আভরণ,
বলো নারী- “এই রক্ত- আলোকে
আজ মম নব জাগরণ!”
পাপে নয় পতি পুণ্যে সুমতি
থাকে যেন, হ’য়ো পতির সারথি।
পতি যদি হয় অন্ধ, হে সতী,
বেঁধো না নয়নে আবরণ
অন্ধ পতিরে আঁখি দেয় যেন
তোমার সত্য আচরণ।।