উৎসর্গ (অগ্নিবীণা)

ভাঙা বাংলার রাঙা যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্নিক বীর
শ্রীবারীন্দ্রকুমার ঘোষ
শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু
.

অগ্নি-ঋষি! অগ্নি-বীণা তোমায় শুধু সাজে।
তাই তো তোমার বহ্নি-রাগেও বেদন-বেহাগ বাজে॥
দহন-বনের গহন-চারী–
হায় ঋষি– কোন্ বংশীধারী
নিঙ্‌ড়ে আগুন আন্‌লে বারি
অগ্নি-মরুর মাঝে৷৷
সর্বনাশা কোন্ বাঁশি সে বুঝ্‌তে পারি না যে॥
.

দুর্বাসা হে! রুদ্র তড়িৎ হান্‌ছিলে বৈশাখে,
হঠাৎ সে কার শুন্‌লে বেণু কদম্বের ঐ শাখে।
বজ্রে তোমার বাজ্‌ল বাঁশি,
বহ্নি হলো কান্না হাসি,
সুরের ব্যথায় প্রাণ উদাসী–
মন সরে না কাজে।
তোমার নয়ন-ঝুরা অগ্নি-সুরেও রক্ত-শিখা বাজে॥

প্রলয়োল্লাস

তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

আস্‌ছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য-পাগল,
সিন্ধু-পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙ্‌ল আগল।
      মৃত্যু-গহন অন্ধ-কূপে
      মহাকালের চণ্ড-রূপে–
                ধূম্র-ধূপে
বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আস্‌ছে ভয়ঙ্কর–
      ওরে ঐ হাস্‌ছে ভয়ঙ্কর!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!
 

ঝামর তাহার কেশের দোলায় ঝাপ্‌টা মেরে গগন দুলায়,
সর্বনাশী জ্বালা-মুখী ধূমকেতু তার চামর ঢুলায়!
      বিশ্বপাতার বক্ষ-কোলে
      রক্ত তাহার কৃপাণ ঝোলে
                দোদুল্‌ দোলে!
অট্টরোলের হট্টগোলে স্তব্ধ চরাচর–
      ওরে ঐ স্তব্ধ চরাচর!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!
 

দ্বাদশ রবির বহ্নি-জ্বালা ভয়াল তাহার নয়ন-কটায়,
দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়!
      বিন্দু তাহার নয়ন-জলে
      সপ্ত মহাসিন্ধু দোলে
                       কপোল-তলে!
বিশ্ব-মায়ের আসন তারি বিপুল বাহুর ‘পর–
      হাঁকে ঐ ‘জয় প্রলয়ঙ্কর!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

মাভৈ মাভৈ! জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে!
জরায়-মরা মুমূর্ষদের প্রাণ লুকানো ঐ বিনাশে!
      এবার মহা-নিশার শেষে
      আস্‌বে ঊষা অরুণ হেসে
                        করুণ বেশে!
দিগম্বরের জটায় লুটায় শিশু চাঁদের কর,
      আলো তার ভর্‌বে এবার ঘর।
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

 

ঐ সে মহাকাল-সারথি রক্ত-তড়িত-চাবুক হানে,
রণিয়ে ওঠে হ্রেষার কাঁদন বজ্র-গানে ঝড়-তুফানে!
খুরের দাপট তারায় লেগে উল্কা ছুটায় নীল খিলানে!
                    গগন-তলের নীল খিলানে।
      অন্ধ করার বন্ধ কূপে
      দেবতা বাঁধা যজ্ঞ-যূপে
                          পাষাণ স্তূপে!
এই তো রে তার আসার সময় ঐ রথ-ঘর্ঘর–
      শোনা যায় ঐ রথ-ঘর্ঘর।
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!
 

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? –প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!
আসছে নবীন– জীবন-হারা অ-সুন্দরে কর্‌তে ছেদন!
      তাই সে এমন কেশে বেশে
      প্রলয় বয়েও আস্‌ছে হেসে–
                           মধুর হেসে!
ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!
 

ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!–
      বধূরা প্রদীপ তুলে ধর্‌!
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!–
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!
      তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!!

রক্তাম্বরধারিণী মা

রক্তাম্বর পর মা এবার
জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন।
দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন
বাজে তরবারি ঝনন-ঝন।
সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেল মা গো
জ্বাল সেথা জ্বাল কাল্-চিতা।
তোমার খড়গ-রক্ত হউক
স্রষ্টার বুকে লাল ফিতা।
এলোকেশে তব দুলুক ঝন্‌ঝা
কাল-বৈশাখী ভীম তুফান,
চরণ-আঘাতে উদ্গারে যেন
আহত বিশ্ব রক্ত-বান।
নিশ্বাসে তব পেঁজা-তুলো সম
উড়ে যাক মা গো এই ভুবন,
অ-সুরে নাশিতে হউক বিষ্ণু
চক্র মা তোর হেম-কাঁকন।
টুটি টপে মারো অত্যাচারে মা,
গল-হার হোক নীল ফাঁসি,
নয়নে তোমার ধূমকেতু-জ্বালা
উঠুক সরোষে উদ্ভাসি।
হাসো খলখল, দাও করতালি,
বলো হর হর শঙ্কর!
আজ হতে মা গো অসহায় সম
ক্ষীণ ক্রন্দন সম্বর।
মেখলা ছিঁড়িয়া চাবুক করো মা,
সে চাবুক করো নভ-তড়িৎ,
জালিমের বুক বেয়ে খুন ঝরে
লালে-লাল হোক শ্বেত হরিৎ।
নিদ্রিত শিবে লাথি মারো আজ,
ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা,
পিয়াও এবার অ-শিব গরল
নীলের সঙ্গে লাল মেশা।
দেখা মা আবার দনুজ-দলনী
অশিব-নাশিনী চণ্ডি রূপ;
দেখাও মা ঐ কল্যাণ-করই
আনিতে পারে কি বিনাশ-স্তূপ।
শ্বেত শতদল-বাসিনী নয় আজ
রক্তাম্বরধারিণী মা,
ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর
সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।

আগমনী

একি     রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন–
ঝন      রনরন রন ঝনঝন!
সেকি    দমকি দমকি
                ধমকি ধমকি
           দামা-দ্রিমি-দ্রিমি গমকি গমকি
               ওঠে চোটে চোটে,
          ছোটে লোটে ফোটে
          বহ্নি-ফিনিকি     চমকি   চমকি
                    ঢাল-তলোয়ারে খনখন!
          একি    রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন
                    রণ    ঝনঝন ঝন রণরণ!

 

হৈ       হৈ রব
ঐ       ভৈরব
হাঁকে,   লাখে লাখে
ঝাঁকে   ঝাঁকে ঝাঁকে
লাল     গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে
ওই      পালে পালে,
              ধরা কাঁপে দাপে।
          জাঁকে    মহাকাল কাঁপে থরথর!
          রণে     কড়কড় কাড়া-খাঁড়া-ঘাত,
শির    পিষে হাঁকে রথ-ঘর্ঘর-ধ্বনি ঘররর!
‘গুরু   গরগর’ বোলে ভেরী তূরী,
‘হর    হর হর’
করি   চীৎকার ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন!
ওঠে   ঝন্‌ঝা ঝাপটি দাপটি সাপটি
             হু-হু-হু-হু-হু-হু-শনশন!
ছোটে  সুরাসুর-সেনা হনহন!

 

তাতা   থৈথৈ তাতা থৈথৈ খল খল খল
নাচে   রণ-রঙ্গিণী সঙ্গিনী সাথে,
         ধকধক জ্বলে জ্বলজ্বল
বুকে   মুখে চোখে রোষ-হুতাশন!
        রোস্ কোথা শোন্!

 

ঐ     ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে,
       ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,
       মম-বরুণ কী কল-কল্লোলে চলে উতরোলে
       ধ্বংসে মাতিয়া     তাথিয়া তাথিয়া
                    নাচিয়া রঙ্গে! চরণ-ভঙ্গে
                    সৃষ্টি সে টলে টলমল!

 

ওকি   বিজয়-ধ্বনি সিন্ধু গরজে কলকল কল কলকল!
            ওঠে    কোলাহল,
            কূট      হলাহল
            ছোটে   মন্থনে পুন রক্ত-উদধি,
                      ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল!
টলে   নির্বিকার সে বিধাত্রীরো গো
               সিংহ-আসন টলমল!
কার   আকাশ-জোড়া ও আনত-নয়ানে
              করুণা-অশ্রু ছলছল!

 

বাজে   মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁজর ঝম্‌ঝম,
নাচে   ধূর্জটি সাথে প্রমথ ববম্ বম্‌বম্!
লাল    লালে-লাল ওড়ে ঈশানে নিশান যুদ্ধের,
ওঠে   ওঙ্কার রণ-ডঙ্কার,
নাদে   ওম্ ওম্ মহাশঙ্খ বিষাণ রুদ্রের!
         ছোটে   রক্ত-ফোয়ারা বহ্নির বান রে!
         কোটি   বীর-প্রাণ
         ক্ষণে    নির্বাণ
তবু    শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ
              গমকে শিরায় গম্‌গম্!
ভয়ে   রক্ত-পাগল প্রেত পিশাচেরও
              শিরদাঁড়া করে চন্‌চন্!
যত    ডাকিনী যোগিনী বিস্ময়াহতা,
              নিশীথিনী ভয়ে থম্‌থম্!
বাজে  মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝম্‌ঝম্!

 

ঐ     অসুর-পশুর মিথ্যা দৈত্য-সেনা যত
হত    আহত করে রে দেবতা সত্য!
        স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, মাতাল রক্ত-সুরায়;
                 ত্রস্ত বিধাতা,
মস্ত পাগল পিনাক-পাণি স-ত্রিশূল প্রলয়-হস্ত ঘুরায়!
                              ক্ষিপ্ত সবাই রক্ত-সুরায়!

 

              চিতার উপরে চিতা সারি সারি,
                      চারিপাশে তারি
              ডাকে কুক্কুর গৃহিনী শৃগাল!
              প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!
              প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!!
আজ   রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
         দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!
                    পদতলে লুটে মহিষাসুর,
         মহামাতা ঐ সিংস-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে–
         শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!
                          ‌‌’নাই দানব
                           নাই অসুর,–
                           চাইনে সুর,
                           চাই মানব!’–
               বরাভয়-বাণী ঐ রে কার
               শুনি, নহে হৈ রৈ এবার!

 

                              ওঠ্ রে ওঠ্,
                              ছোট্ রে ছোট্!
                              শান্ত মন,
                              ক্ষান্ত রণ!–

 

                             খোল্ তোরণ,
                             চল্ বরণ
                             করব্ মা’য়;
                             ডর্‌ব কায়?
            ধরব পা’য় কার্ সে আর,
            বিশ্ব-মা’ই পার্শ্বে যার?
আজ   আকাশ-ডোবানো নেহারি তাঁহারি চাওয়া,
ঐ     শেফালিকা-তলে কে বালিকা চলে?
        কেশের গন্ধ আনিছে আশিন-হাওয়া!
        এসেছে রে সাথে উৎপলাক্ষী চপলা কুমারী কমলা ঐ,
                সরসিজ-নিভ শুভ্র বালিকা
      এল            বীণা-পাণি অমলা ঐ!

 

                    এসেছে গনেশ,
                    এসেছে মহেশ,
                    বাস্‌রে বাস্!
                    জোর উছাস্!!
      এল সুন্দর সুর-সেনাপতি,
      সব মুখ এ যে চেনা-চেনা অতি!
      বাস্ রে বাস্‌   জোর উছাস্!!

 

      হিমালয়! জাগো! ওঠো আজি,
                  তব সীমা লয় হোক।
      ভুলে যাও শোক– চোখে জল ব’ক
      শান্তির– আজি শান্তি-নিলয় এ আলয় হোক!
            ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক!
            মা’র আবাহন-গীত্ চলুক!
                দীপ জ্বলুক!
                গীত চলুক!!
আজ   কাঁপুক মানব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখিল ব্যোম্!
                    স্বা-গতম্!
                    স্বা-গতম্!!
                    মা-তরম্!
                    মা-তরম্!!
      ঐ   ঐ  ঐ  বিশ্ব কণ্ঠে
      বন্দনা- বাণী লুণ্ঠে-‘বন্দে মাতরম্!!!

ধূমকেতু

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
সাত— সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে,
মম ধূম-কুণ্ডলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে।
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ,
আমি স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার—
আর মর্তে সাহারা-গোবি-ছাপ,
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ!

আমি সর্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূন্যে,
আমি বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে।
শোঁও শন-নন-নন-শন-নন-নন শাঁই শাঁই,
ঘুর্ পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই
মম পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি;
করি উল্কা-অশনি-বৃষ্টি,—
আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি।
আমি অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!

আমি আপনার বিষ-জ্বালা-মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া
জোর বুঁদ হয়ে আমি চলেছি ধাইয়া ভাইয়া!
শুনি মম বিষাক্ত ‘রিরিরিরি’-নাদ
শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব-ঘোরার প্রণব-নিনাদ!
ধূর্জটি-শিখ করাল পুচ্ছে
দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাঁটা করে ঘুরাই উচ্চে, ঘুরাই—
আমি অগ্নি-কেতন উড়াই!—

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

ঐ বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত
মম অগ্নি-দাহনে জ্বলে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ!
আমি জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,
তাই বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি।
আমি জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা হয়নি হবে তাও!
তাই বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তাও!
তোর নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুথু দি!
আর যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি।
মম তূরীয় লোকের তির্যক, গতি তূর্য গাজন বাজায়
মম বিষ নিশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!

কচি শিশু-রসনায় ধানি-লঙ্কার পোড়া ঝাল
আর বদ্ধ কারায় গন্ধক ধোঁয়া, এসিড, পটাশ, মোন্ছাল,
আর কাঁচা কলিজায় পচা ঘা’র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি
আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই।
পেলে বাহান্ন-শও জাহান্নমেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!

আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু—
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
আমি শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি,
আমি ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি!
তাই আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘুরে বোঁও করে ফের দু’পাক নি!
কৃতঘ্নী আমি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!

পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর—
শোন্ রে মর, শোন্ অমর!—
সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা!
এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জানো কি তা?
কি বলো? কি বলো? ফের বলো ভাই আমি শয়তান-মিতা!
হো হো ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা!
ছোট শন শন শন ঘর ঘর ঘর সাঁই সাঁই!
ছোট পাঁই পাঁই!
তুই অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই।
ওরে ভয় নাই তোর মার নাই!!
তুই প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু,
তুই উগ্র ক্ষিপ্ত তেজ-মরীচিকা ন’স্ অমরার ঘুম-সেতু
তুই ভৈরব ভয় ধূমকেতু!
আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

ঐ ঈশ্বর-শির উল্লঙ্ঘিতে আমি আগুনের সিঁড়ি,
আমি বসিব বলিয়া পেতেছে ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি!
খ্যাপা মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি
লোকে বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি!
এই শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি
ওরে ছড়ানো রয়েছে, কত যায় গড়াগড়ি!
মহা সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি,
তার ললাটে তপ্ত অভিশাপ-ছাপ এঁকে দিই আমি যদি!
তাই টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,
সে হাসি গুমরি লুটায়ে পড়ে রে তুফান ঝন্ঝা সাইক্লোনে টুটি!

আমি বাজাই আকাশে তালি দিয়া ‘তাতা-উর্-তাক্’
আর সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক!
মম নিশাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে ওঠে ঘুত্কার
আর পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুত্কার!

কাল বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার
তখনি রক্ত শোষে না রে তার,
দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড-সুখে
পুচ্ছ সাপটি খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে!
তেমনি করিয়া ভগবানে আমি
দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী
ঘিরিয়া ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি পিশাচের হাসি
এই অগ্নি-বাঘিনী আমি যে সর্বনাশী!

আজ রক্ত-মাতাল উল্লাসে মাতি রে—
মম পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি,
রক্ত রুদ্র উল্লাসে মাতি রে!
ভগবান? সে তো হাতের শিকার!— মুখে ফেনা উঠে মরে!
ভয়ে কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের পরে!
অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়া
অজগর কাল-কেউটে সে কোনো ফিরিয়া ফিরিয়া
চায়, আর ঘোরে শন্ শন্ শন্,
ভয়-বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন—
তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে
ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে;
আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম
বিধাতা তাদের কাঁপিছে রুদ্র ঘূর্ণির মাঝে মম!

আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে,
স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি পাছে বা বড় হয়ে তারে গ্রাসে!

আনোয়ার

[স্থান– প্রহরী–বেষ্টিত অন্ধকার কারাগৃহ, কনস্ট্যান্টিনোপ্‌ল্‌।
কাল–অমাবস্যার নিশীথ রাত্রি।]

[চারিদিকে নিস্তব্ধ নির্বাক। সেই মৌনা নিশীথিনীকে ব্যথা দিতেছিল শুধু কাফ্রি-সাস্ত্রীর পায়চারির বিশ্রী খট্‌খট্ শব্দ। ঐ জিন্দানখানায় মহাবাহু আনোয়ারের জাতীয়-সৈন্যদলের সহকারী এক তরুণ সেনানী বন্দী। তাহার কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, ডাগর চোখ, সুন্দর গঠন– সমস্ত-কিছুতে যেন একটা ব্যথিত-বিদ্রোহের তিক্ত-ক্রন্দন ছলছল করিতেছিল। তরুণ প্রদীপ্ত মুখমণ্ডলে চিন্তার রেখাপাতে তাহাকে তাহার বয়স অপেক্ষা অনেকটা বেশি বয়স্ক বোধ হইতেছিল।
সেইদিনই ধামা-ধরা সরকারের কোর্ট-মার্শালের বিচারে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে যে, পরদিন নিশিভোরে তরুণ সেনানীকে তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হইবে।
আজ হতভাগ্যের সেই মুক্তি-নিশীথ, জীবনের সেই শেষরাত্রি। তাহার হাতে, পায়ে, কটিদেশে, গর্দানে উৎপীড়নের লৌহ-শৃঙ্খল। শৃঙ্খল-ভারাতুর তরুণ সেনানী স্বপ্নে তাহার ‘মা’-কে দেখিতেছিল। সহসা চীৎকার করিয়া সে জাগিয়া উঠল। তাহার পর চারিদিকে কাতর নয়নে একবার চাহিয়া দেখিল, কোথাও কেহ নাই। শুধু হিমানি-সিক্ত বায়ু হা হা স্বরে কাঁদিয়া গেল, ‘হায় মাতৃহারা!’
স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা স্মরণ করিয়া তরুণ সেনানী ব্যর্থ-রোষে নিজের বাম বাহু নিজে দংশন করিয়া ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিল। কারাগৃহের লৌহ-শলাকায় তাহার শৃঙ্খলিত দেহভার বারেবারে নিপতিত হইয়া কারা-গৃহ কাঁপাইয়া তুলিতেছিল।
এখন তাহার অস্ত্র-গুরু আনোয়ারকে মনে পড়িল। তরুণ বন্দী চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘আনোয়ার!’–]

আনোয়ার! আনোয়ার!
দিলাওয়ার তুমি, জোর তলওয়ার হানো, আর
নেস্ত-ও-নাবুদ করো, মারো যত জানোয়ার!
আনোয়ার! আফসোস্!
বখতেরই সাফ্ দোষ,
রক্তেরও নাই ভাই আর সে যে তাপ জোশ,
ভেঙে গেছে শম্‌শের–পড়ে আছে খাপ কোষ!
আনোয়ার! আফসোস্!

আনোয়ার! আনোয়ার!
সব যদি সুম্‌সাম, তুমি কেন কাঁদো আর?
দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার!
আনোয়ার! আর না!–
দিল্ কাঁপে কার না?
তল্‌ওয়ারে তেজ নাই! –তুচ্ছ স্মার্ণা,
ঐ কাঁপে থরথর মদিনার দ্বার না?
আনোয়ার! আর না!

আনোয়ার! আনোয়ার!
বুক ফেড়ে আমাদের কলিজাটা টানো, আর
খুন করো –খুন করো ভীরু যত জানোয়ার!
আলোয়ার! জিঞ্জির–
পরা মোরা খিঞ্জির!
শৃঙ্খলে বাজে শোনো রোণা রিণ-ঝিণ্ কির,–
নিবু নিবু ফোয়ারা বহ্নির ফিন্‌কির!
গর্দানে জিঞ্জির!

আনোয়ার! আনোয়ার!
দুর্বল্ এ গিদ্‌ধড়ে কেন তড়্‌পানো আর?
জোরওয়ার শের কই? জের্‌বার জানোয়ার!
আনোয়ার! মুশ্‌কিল
জাগা কঞ্জুশ্-দিল,
ঘিরে আসে দাবানল তবু নাই হুঁশ তিল!
ভাই আজ শয়তান ভাই-এ মারে ঘুষ কিল!
আনোয়ার! মুশ্‌কিল!

আনোয়ার! আনোয়ার!
বেইমান মোরা, নাই জান আধ-খানও আর।
কোথা খোঁজো মুস্‌লিম? –শুধু বুনো জানোয়ার!
আনোয়ার! সব শেষ!–
দেহে খুন অবশেষ!–
ঝুটা তেরি তলওয়ার ছিন্ লিয়া যব্ দেশ !
আওরত সম ছি ছি ক্রদন রব পেশ ! !
আনোয়ার ! সব শেষ !

আনোয়ার ! আনোয়ার !
জনহীন এ বিয়াবানে মিছে পস্তানো আর !
আজো যারা বেঁচে আছে তারা খ্যাপা জানোয়ার !
আনোয়ার ! –কেউ নাই !
হাথিয়ার? –সেও নাই !
দরিয়াও থম্‌থম্ নাই তাতে ঢেউ, ছাই !
জিঞ্জির গলে আজ বেদুঈন-দে’ও ভাই !
আনোয়ার ! কেউ নাই !

আনোয়ার ! আনোয়ার !
যে বলে সে মুস্‌লিম– জিভ্ ধরে টানো তার !
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার !
আনোয়ার ! ধিক্কার !
কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার–
তল্ওয়ারে শুরু যার স্বধীনতা শিক্ষার!
যারা ছিল দুর্দম আজ তারা দিক্‌দার!
আনোয়ার! ধিক্কার!

আনোয়ার ! আনোয়ার!
দুনিয়াটা খুনিয়ার, তবে কেন মনো আর
রুধিরের লোহু আঁখি? –শয়তানি জানো সার!
আনোয়ার ! পঞ্জায়
বৃথা লোকে সম্‌ঝায়,

ব্যথা-হত বিদ্রোহী দিল্‌ নাচে ঝন্‌ঝায়,
খুন-খেগো তল্‌ওয়ার আজ শুধু রণ্ চায়,
আনোয়ার ! পঞ্জায়!
আনোয়ার ! আনোয়ার!
পাশা তুমি নাশা হও মুসলিম-জানোয়ার,
ঘরে যত দুশ্‌মন, পরে কেন হানো মার?–
আনোয়ার ! এসো ভাই!
আজ সব শেষও যাই!–
ইস্‌লামও ডুবে গেল, মুক্ত স্বদেশও নাই!-
তেগ ত্যাজি বরিয়াছি ভিখারির বেশও তাই!
আনোয়ার ! এসো ভাই!!

[সহসা কাফ্রি সাস্ত্রীর ভীম চ্যালেঞ্জ্ প্রলয়-ডম্বরু-ধ্বনির মতো হুঙ্কার দিয়া উঠিল– ‘এয়্ নৌজওয়ান, হুঁশিয়ার!’ অধীর ক্ষোভে তিক্ত রোষে তরুণের দেহের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিল! তাহার কটিদেশের, গর্দানের, পায়ের শৃঙ্খল খানখান হইয়া টুটিয়া গেল, শুধু হাতের শৃঙ্খল টুটিল না। সে সিংহ-শাবকের মতো গর্জন করিয়া উঠিল–]
এয়্ খোদা! এয়্ আলি! লাও মেরি তলোয়ার!

[সহসা তাহার ক্লান্ত আঁখির চাওয়ায় তুরস্কের বন্দিনী মাতৃ-মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। ঐ মাতৃমূর্তির পার্শ্বেই তাহার মায়েরও শৃঙ্খলিত ভিখারিনি বেশ। তাঁদের দুইজনেরই চোখের কোণে দুই বিন্দু করিয়া করুণ অশ্রু। অভিমানী পুত্র অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল–]

ও কে? ও কে ছল আর?
না-মা, মরা জানকে এ মিছে তর্‌সানো আর!
আনোয়ার ! আনোয়ার!!

[কাপুরুষ প্রহরীর ভীম প্রহরণ বিনিদ্র বন্দী তরুণ সেনানীর পৃষ্ঠের উপর পড়িল। অন্ধ কারাগারের বন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাহারই আর্ত প্রতিধ্বনি গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল-‘আঃ-আঃ-আঃ!’
আজ নিখিল বন্দী-গৃহে গৃহে ঐ মাতৃমুক্তিকামী তরুণেরই অতৃপ্ত কাঁদন ফরিয়াদ করিয়া ফিরিতেছে। যেদিন এ ক্রন্দন থামিবে, সেদিন সে-কোন্ অচিন্ দেশে থাকিয়া গভীর তৃপ্তির হাসি হাসিব জানি না! তখন হয়তো হারা-মা-আমার আমায় ‘তারার পানে চেয়ে চেয়ে’ ডাকবেন। আমিও হয়তো আবার আসিব। মা কি আমায় তখন নূতন নামে ডাকিবেন? আমার প্রিয়জন কি আমায় নূতন বাহুর ডোরে বাঁধিবে? আমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে, আর কেন যেন মনে হইতেছে, ‘আসিবে সেদিন আসিবে!’]
———————————-
সুমসাম– নিঝঝুম।
জিঞ্জির– শৃঙ্খল
খিঞ্জির– শূকর
রোণা– ক্রন্দন
জোরওয়ার– বলবান
শের– বাঘ
গিদ্‌ড়ে– শৃগাল
জোরবার– ক্ষত-বিক্ষত
কঞ্জুশ্-দিল– কৃপণ মন
বিয়াবান– মরুভূমি।
হাথিয়ার– অস্ত্র
দিক্‌দার– তিক্ত-বিরক্ত
তেগ– তলোয়ার।
তরসানো– দুঃখে দেওয়া

রণ ভেরী

[গ্রীসের বিরুদ্ধে আঙ্গোরা-তুর্ক-গভর্ণমেন্ট যে যুদ্ধ চালাইতেছিলেন, সেই যুদ্ধে কামাল পাশার সাহায্যের জন্য ভারতবর্ষ হইতে দশ হাজার স্বেচ্ছা-সৈনিক প্রেরণের প্রস্তাব শুনিয়া লিখিত]

ওরে আয়!
ঐ মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়–
ওরে আয়!
ঐ ইস্‌লাম ডুবে যায়!
যত শয়তান
সারা ময়দান
জুড়ি খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়-গান শোন্ গায়!
আজ শখ করে জুতি-টক্করে
তোড়ে শহীদের খুলি দুশ্‌মন পায় পায়–
ওরে আয়!
তোর জান যায় যাক, পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায়!
ধরে ঝন্‌ঝার ঝুঁটি দাপটিয়া শুরু মুস্‌লিম-পঞ্জায়!
তোর মান যায় প্রাণ যায়–
তবে বাজাও বিষাণ, ওড়াও নিশান! বৃথা ভীরু সম্‌ঝায়!
রণ- দুর্মদ রণ চায়!
ওরে আয়!
ঐ মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!
ওরে আয়!
ঐ ঝননননন রণ-ঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়!
শুনি এই ঝন্‌ঝনা-ব্যঞ্জনা নেবে গঞ্জনা কে রে হায়?
ওরে আয়!
তোর ভাই ম্লান চোখে চায়,
মরি লজ্জায়,
ওরে সব যায়,
তবু কব্‌জায় তোর শম্‌শের নাহি কাঁপে আফ্‌সোসে হায়?
রণ- দুন্দুভি শুনি খুন-খুবি
নাহি নাচে কি রে তোর মরদের ওরে দিলিরের গোর্দায়?

ওরে আয়
মোরা দিলাবার খাঁড়া তলোয়ার হাতে আমাদেরি শোভা পায়!
তারা খিঞ্জির যারা জিঞ্জির-গলে ভূমি চুমি মূরছায়!
আরে দূর দূর! যত কুক্কুর
আসি শের-বব্বরে লাথি মারে ছি ছি ছাতি চড়ে! হাতি
ঘা‌’ল হবে ফেরু-ঘায়?
ঐ ঝননননন রণঝনঝন ঝন্‌ঝনা শোনা যায়!
ওরে আয়!
বোলে দ্রিম্‌ দ্রিম্ তানা দ্রিম, দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়!
ঐ শের-নর হাঁকড়ায়–
ওরে আয়!
ছোড়্ মন-দুখ,
হোক কন্দুক
ঐ বন্দুক তোপ, সন্দুক তোর পড়ে থাক, স্পন্দুক বুক ঘা’য়!
নাচ্ তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ–
থৈ তা‌ণ্ডব, আজ পাণ্ডব সম খাণ্ডব-দাহ চাই!

ওরে আয়!
কর কোর্‌বান আজ তোর জান দিল্ আল্লার নামে ভাই।
ঐ দীন্ দীন্-রব আহব বিপুল বসুমতী ব্যোম ছায়!
শেল– গর্জন
করি তর্জন
হাঁকে, বর্জন নয় অর্জন আজ, শির তোর চায় মায়!
সব গৌরব যায় যায়;
বোলে দ্রিম্ দ্রিম্ তানা দ্রিম্ দ্রিম্ ঘন রণ-কাড়া-নাকাড়ায়!
ওরে আয় !
ঐ কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সাজ্জায়!
ওরে আয়!
মুখ ঢাকিবি কি লজ্জায়?

হুর্ হুর্‌রে।
কত দূর রে
সেই পুর রে যথা খুন-খোশ্‌রোজ খেলে হর্‌রোজ দুশ্‌মন-খুনে ভাই!
সেই বীর-দেশে চল্ বীর-বেশে,
আজ মুক্ত দেশে রে মুক্তি দিতে রে বন্দীরা ঐ যায়!
ওরে আয়!
বল্‌ ‘জয় সত্যম্ পুরুযোত্তম’, ভীরু যারা মার খায়!
নারী আমাদেরি শুনি রণ-ভেরী হাসে খলখল হাত-তালি দিয়ে রণে ধায়!
মোরা রণ চাই রণ চাই,
তবে বাজহ দামামা, বাঁধই আমামা, হাথিয়ার পাঞ্জায়!
মোরা সত্য ন্যায়ের সৈনিক, খুন-গৈরিক বাস গা’য়।
ওরে আয়!
ঐ কড়কড় বাজে রণ-বাজা, সাজ সাজ রণ-সজ্জায়!
ওরে আয়!
অব– রুদ্ধের দ্বারে যুদ্ধের হাঁক নকিব ফুকারি যায়!
তোপ্ দ্রুম্ দ্রুম্ গান গায়!
ওরে আয়!

ঐ ঝননরণন খঞ্জর-ঘাত পঞ্জরে মূরছায়!
হাঁকো হাইদার,
নাই নাই ডর,
ঐ ভাই তোর ঘুর-চর্খীর সম খুন খেয়ে ঘুর্ খায়!
ঝুটা দৈত্যেরে
নাশি সত্যেরে
দিবি জয়-টীকা তোরা, ভয় নাই ওরে ভয় নাই হত্যায়!

ওরে আয়!
মোরা খুন্‌-জোশি বীর, কঞ্জুশি লেখা আমাদের খুনে নাই!
দিয়ে সত্য ও ন্যায়ে বাদশাহি, মোরা জালিমের খুন খাই!
মোরা দুর্মদ, ভর্‌পুর্ মদ
খাই ইশ্‌কের, ঘাত-শম্‌শের ফের নিই বুক নাঙ্গায়!
লাল পল্টন মোরা সাচ্চা,
মোরা সৈনিক, মোরা শহীদান বীর বাচ্চা,
মরি জালিমের দাঙ্গায়!
মোরা অসি বুকে বরি হাসি মুখে মরি জয় স্বাধীনতা গাই!
ওরে আয়!
ঐ মহা-সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়!!
——————————-
শম্‌শের– তরবারি।
খুন-খুবি– রক্তোন্মত্ততা
দিলির– সাহসী, নির্ভীক
দিলবার– প্রাণবন্তা।
জিঞ্জির– শিকল
শের-বববরে– সিংহ
শের-নর– পুরুষসিংহ
হাঁকাড়ায়– গর্জন করিতেছি
কোরবান– উৎসর্গ
খুন-খোশ-রোজ– রক্ত-মহোৎসব।
হররোজ– প্রতিদিন
আমামা – শিরস্ত্রাণ
নকিব– তূর্যবাদক
হাইদার– মহাবীর হজরত আলীর হাঁক
খুন-জোশ– রক্ত-পাগলামি
কঞ্জুশি– কৃপণতা
ইশকের– প্রেমের
শহীদান– Martyrs

শাত-ইল-আরব

শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
শহীদের লোহু, দিলিরের খুন ঢেলেছে যেখানে আরব-বীর।
যুঝেছে এখানে তুর্কি-সেনানী,
য়ুনানি, মিস্‌রি, আর্‌বি, কেনানি–
লুটেছে এখানে মুক্ত আজাদ্‌ বেদুঈন্‌দের চাঙ্গা শির!
নাঙ্গা-শির্–
শম্‌শের হাতে, আঁসু-আঁখে হেথা মূর্তি দেখেছি বীর-নারীর!
শাতিল্ আরব! শাতিল্ আরব!! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
‘কুত-আমারা’র রক্তে ভরিয়া
দজ্‌লা এনেছে লোহুর দরিয়া;
উগারি সে খুন তোমাতে দজ্‌লা নাচে ভৈরব ‘মস্তানি’র।
এস্তা-নীর
গর্জে রক্ত-গঙ্গা ফোরাত, –’শাস্তি দিয়েছি গোস্তাখির!’
দজ্‌লা-ফোরাত-বাহিনী শাতিল! পূত যুগে যুগে তোমার তীর।
বহায়ে তোমার লোহিত বন্যা
ইরাক আজমে করেছ ধন্যা;–
বীর-প্রসূ দেশ হলো বরেণ্যা মরিয়া মরণ মর্দমির!
মর্দ বীর
সাহারায় এরা ধুঁকে মরে তবু পরে না শিকল পদ্ধতির।

শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব্! পূত যুগে যুগে তোমার তীর!
দুশ্‌মন্-লোহু ঈর্ষায়-নীল
তব তরঙ্গে করে ঝিলমিল্,
বাঁকে বাঁকে রোষে মোচড় খেয়েছ পিয়ে নীল খুন পিণ্ডারির!
জিন্দা বীর

‘জুলফিকার’ আর ‘হায়দরি’ হাঁক হেথা আজো হজরত্ আলীর-
শাতিল্-আরব!-শাতিল্-আরব!! জিন্দা রেখেছে তোমার তীর।
ললাটে তোমার ভাস্বর টীকা
বস্‌রা-গুলের বহ্নিতে লিখা–
এ যে বসোরার খুন-খারাবি গো রক্ত-গোলাব-মঞ্জরীর!
খঞ্জরীর
খঞ্জরে ঝরে খর্জুর সম হেথা লাখো দেশ-ভক্ত-শির!
শাতিল্-আরব! শাতিল্-আরব!! পূত যুগে তোমার তীর।
ইরাক-বাহিনী! এ যে গো কাহিনী,–
কে জানিত কবে বঙ্গ-বাহিনী
তোমারও দুঃখে ‘জননী আমার!’ বলিয়া ফেলিবে তপ্ত নীর!
রক্ত-ক্ষীর–
পরাধীনা! একই ব্যথায় ব্যথিত ঢালিল দু-ফোঁটা ভক্ত-বীর।
শহীদের দেশ! বিদায়! বিদায়!! এ অভাগা আজ নোয়ায় শির!
—————————–
শাতিল আরব– আরব দেশের একটি নদীর নাম।
দিলির– অসম সাহসী
য়ুয়ানি– য়ুনান দেশের অধিবাসী
মিস্‌রিা– মিশরের অধিবাসী
কেনানি– কেনানের অধিবাসী
চাঙ্গা– টাটকা
কুত-আমারা–
কুতল-আমার নামক স্থান, যেখানে জেনারেল টাউনসেন্ড বন্দী হন।

কোরবানি

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,–
আজিকার এ খুন কোর্‌বানির!
দুম্বা-শির রুম্-বাসীর
শহীদের শির-সেরা আজি। –রহমান কি রুদ্র নন?
বাস্‍! চুপ খামোশ রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর ‘খুন দে, জান দে, শির দে বৎস’ শোন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
খঞ্জর মারো গর্দানেই,
পঞ্জরে আজি দরদ নেই,
মর্দানি’ই পর্দা নেই
ডর্‌তা নেই আজ খুন্-খারাবিতে রক্ত-লুব্ধ মন!
খুনে খেল্‌ব খুন্-মাতন!
দুনো উন্মাদনাতে সত্য মুক্তি আন্‌তে যুঝ্‌র রণ।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
চড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার
মুস্‌লিমে সারা দুনিয়াটার।
‘জুল্‌ফেকার’ খুল্‌বে তার
দু’ধারী ধার্‌ শেরে-খোদার রক্তে-পূত-বদন!
খনে আজকে রুধ্‌ব মন!
ওরে শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,
‘আজাদি’ মেলে না পস্তানোয়!
দস্তা নয় সে সস্তা নয়!
হত্যা নয় কি মৃত্যুও? তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্
কাঁদে-শক্তি-দুঃস্থ শোন্–

‘এয়্‌ ইব্‌রাহিম্ আজ কোর্‌বানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন!’
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
এ তো নহে লোহু তরবারের
ঘাতক জালিম জোর্‌বারের!
কোরবানের জোর-জানের
খুন এ যে, এতে গোর্দা ঢের রে, এ ত্যাগে ‘বুদ্ধ’ মন!
এতে মা রাখে পুত্র পণ্!
তাই জননী হাজেরা বেটারে পরাল বলির পূত বসন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
এই দিনই ‘মীনা’-ময়দানে
পুত্র-স্নেহের গর্দানে
ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে
রেখেছে আব্বা ইব্‌রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!
ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন!
আজ জল্লাদ নয়, প্রহলাদ সম মোল্লা খুন-বদন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
দ্যাখ্ কেঁপেছে ‘আরশ’ আস্‌মানে,
মন-খুনি কি রে রাশ মানে?
ত্রাস প্রাণে?-তবে রাস্তা নে‍!
প্রলয়- বিষাণ কিয়ামতে তবে বাজাবে কোন্ বোধন?
সেকি সৃষ্টি-সংশোধন?
ওরে তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!–
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
মুস্‌লিম-রণ-ডঙ্কা সে,
খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?
টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে
ওরে হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম কারা লড়ব রণ-মরণ!
ঢালে বাজ্‌বে ঝন্-ঝনন!
ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
জোর চাই আর যাচ্‌না নয়
কোরবানি-দিন আজ না ওই?
বাজ্‌না কই? সাজ্‌না কই?
কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?
বল্– ‘যুঝ্‌ব জান্ ভি পণ!’
ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ!
আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্‌বোধন।
———————————–
রহমান– করুণাময়
খামোশ– নীরব।
গর্দানে– স্কন্ধে
জান্নাত– স্বর্গ
জুলফেকার– মহাবীর হজরত আলীর বিশ্বত্রাস তরবারি
শের-খোদা– খোদার সিংহ; হজরত আলীকে এই গৌরাবান্বিত নামে অভিহিত করা হয়।
জোরবার– বলদৃপ্ত
জোর-জান– মহাপ্রাণ
আজাদি– মুক্তি
আব্বা– বাবা
ইবরাহিম– Abraham
হাজেরা– হজরত ইবরাহীমের স্ত্রী

মোহর্‌রম

নীল সিয়া আসমা লালে লাল দুনিয়া,–
‘আম্মা ! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’।
কাঁদে কোন্ ক্রদসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে !
রুদ্র মাতম্ ওঠে দুনিয়া দামেশকে–
‘জয়নালে পরাল এ খুনিয়ারা বেশ কে?
‘হায় হায় হোসেনা’ ওঠে রোল ঝন্‌ঝায়,
তল্‌ওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায়!
উন্‌মাদ ‘দুলদুল্’ ছুটে ফেরে মদিনায়,
আলি-জাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়!
মা ফাতেমা আস্‌মানে কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেতবাস!
রণে যায় কাসিম্ ঐ দু’ঘড়ির নওশা,
মেহেদির রঙটুকু মুছে গেল সহসা!
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও দখিনা–
‘কঙ্কণ পঁইচি খুলে ফেলো সকিনা!’
কাঁদে কে রে কোলে করে কাসিমের কাটা-শির?
খান্‌খান্ খুন হয়ে ক্ষরে বুক-ফাটা নীর!
কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’
নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার!
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্‌মনও ‘সাব্বাস’!
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা!’
মা’র থনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্‌পায়!
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়্‌টায়?
দাউদাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
কাঁদে বানু–’পানি দাও, মরে জাদু আস্‌গর!’
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
খাঁ খাঁ করে কার্‌বালা, নাই পানি খর্জুর,
পেল না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, –পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্!
পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে
ছিঁড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাঁধনে!
তাম্বুতে শয্যায় কাঁদে একা জয়নাল,
‘দাদা! তেরি হর্ কিয়া বর্‌বাদ্ পয়মাল!’
হাইদরি-হাঁক হাঁকি দুল্‌দুল্-আস্‌ওয়ার
শম্‌শের চম্‌কায় দুশমনে ত্রাস্‌বার!
খসে পড়ে হাত হতে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার।
নিঃশেষ দুশ্‌মন্; ওকে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত?
কোথা বাবা আস্‌গর্? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসনের ফেটে যায় পাঁজরা!
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয়নি রে বাছাদের মুখে কম্‌জাত্‌রা!
অঞ্জলি হতে পানি পড়ে গেল ঝর্-ঝর্
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জর!
হল্‌কুমে হানে তেগ ও কে বসে ছাতিতে?–
আফ্‌তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে!
আস্‌মান ভরে গেল গোধূলিতে দুপরে,
লাল নীল খুন ঝরে কুফরের উপরে!
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে, আহ্–
‘আরশের পায়া ধরে কাঁদে মাতা ফাতেমা,
‘এয়্ খোদা বদ্‌লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জনা করো গোনা পাপী কম্‌বখ্‌তের!’
কত মোহর্‌রম্ এল্ গেল চলে বহু কাল–
ভুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুস্‌লিম্! তোরা আজ জয়নাল আবেদিন,
‘ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এল আজ সেই মোহর্‌রম মাহিনা,–
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না!
উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ্ আরবির,
দুনিয়াতে নত নয় মুস্‌লিম কারো শির;–
তবে শোনো ঐ শোনো বাজে কোথা দামামা,
শম্‌শের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকিবের তূর্য,
হুশিয়ার ইস্‌লাম, ডুবে তব সূর্য!
জাগো ওঠো মুস্‌লিম, হাঁকো হাইদরি হাঁক।
শহীদের দিনে সব-লালে-লাল হয়ে যাক!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তিন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন।
হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের;
আস্‌গর সম দিব বাচ্চারে কোর্‌বান,
জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান!
সকিনার শ্বেতবাস দেব মাতা কন্যায়,
কাসিমের মতো দেবো জান রুধি অন্যায়!
মোহর্‌রম্! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’
দেখো মরু-সূর্যে এ খুন যেন শোষে না!

———————————–
আরশ–খোদার সিংহাসন।
আম্মা –মা।
লা’ল–জাদু।
মাতম –হাহা ক্রন্দন।
দুনিয়া-দামেশকে– দামেশক-রূপ দুনিয়ায়।
আমামা–শিরস্ত্রাণ।

বানু –আসগরের মাতা।
আসগর –ইমাম হোসেনের শিশুপুত্র।
জয়নাল –ইমাম হোসেনের পুত্র।
বরবাদ –নষ্ট।
পয়মাল –ধ্বংস।
দুলদুল-আসওয়ার –’দুলদুল’ ঘোড়ার সওয়ার ইমাম হোসেন।
এক কাৎরা –এক বিন্দু।
কমজাতরা –নীচমনাগণ।
হলকুম –কণ্ঠ।
তেগ –তরবারি।
আফতাব –সূর্য।
কমবখ্‌ত –হতভাগ্য

মর্সিয়া –শোক-গীতি।
শম্‌শের –তরবারি।
নকিব –তূর্যবাদক।
জহর –বিষ।
কহর –অভিশাপ।
দাদ –প্রতিশোধ।